পরিবেশ রক্ষায় ভোগবাদী জীবনচর্চা পরিহার জরুরি: ড. গৌতম পাল
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক ও ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি অধ্যাপক ড. গৌতম পাল। একজন অসাধারণ শিক্ষক এবং বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, লেখক, সংগঠক, সমাজ চিন্তক হিসেবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে গোটা বিশ্বব্যাপী। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় গোলাম রাশিদ
১. আপনি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বিভাগের বরিষ্ঠ শিক্ষক এবং বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন। দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। এই জার্নিটা নিয়ে কিছু বলুন৷
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এক কৃষক পরিবারের সন্তান আমি৷ জীবনে আমাকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত৷ স্কুলশিক্ষা সম্পন্ন হয় জেলাতেই৷ ঐতিহ্যবাহী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার বিএসসি অনার্স, এমএসসি, এমফিল ও পিএইচডির পড়াশোনা৷ ফিজিওলজি এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলাম৷ সে এক ভিন্নরকম অনুভূতি৷ পরবর্তীতে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিওলজি থেকে ডিএসসি৷
২. এ প্রসঙ্গে আপনার গবেষণার বিষয় সম্বন্ধে জানতে চাইব৷
আমি সবসময় মনে করি, মানুষের জন্য বিজ্ঞান৷ গবেষণা যেন সেই কাজে লাগে৷ সেই চেষ্টাই করে এসেছি৷ আমার প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ১৩০-এর অধিক৷ বিজ্ঞানের উপর জনপ্রিয় বই রয়েছে অনেকগুলি। কোভিড নিয়েও বই রয়েছে ‘কোভিড-১৯ ও জনস্বাস্থ্য’ নামে৷ পরিবেশ বিজ্ঞানের পাঠক্রম তৈরি এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের গবেষণায় সমগ্র ভারতবর্ষের নিরিখে কাজ করেছি। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপর বাংলা ভাষায় রচিত আমার এক হাজার পৃষ্ঠার উপরের বইটি দীর্ঘ কুড়ি বছর যাবত্ বহু পাঠক, ছাত্র-ছাত্রী, গবেষকদের কাছে দরকারি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে৷ আর্সেনিক দূষণ নিয়ে গবেষণা করে ডিএসসি উপাধি লাভ। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে বিভিন্ন প্রাদেশিক দৈনিক খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন এবং পত্র-পত্রিকায় আমি নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে থাকি৷
৩. ভারতের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে বাংলার মুখ উজ্জল করেছেন আপনি৷ এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷ প্রশাসক হিসেবে সমাজকে কেমন চোখে দেখছেন?
এই দায়িত্ব দায়বদ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়৷ আমি সামাজিক দায়বদ্ধতাতে বিশ্বাস করি৷ বর্তমানে দেখি অনেকেই নৈতিকতা, কর্তব্যবোধের সঙ্গে আপস করে থাকেন৷ সাধারণ মানুষের জন্য যদি কিছু করে যেতে পারাটাই তৃপ্তির৷ অনেকে রিকশাওয়ালা, ফলওয়ালাদের ‘তুই’ বলেন৷ আমি তেমন করি না৷ ‘আপনি’ বলি৷ প্রয়োজন হলে রিকশার ভাড়া বেশি দিই৷ কিন্তু কম দিই না৷ ওদের প্রয়োজনটা আমাদের বুঝতে হবে৷ এখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করছে তরুণ প্রজন্ম৷ আমার কথা হল, ওয়েস্টার্ন কালচারের ভালো গুণগুলো নিতে হবে৷ তবেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব সামনের দিকে৷
৪. জলবায়ু পরিবর্তন এখন এক ভয়ঙ্কর সংকট রূপে দেখা দিয়েছে৷ আপনি এ নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন…
হ্যাঁ, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ আমরা নানা কাজে প্লাস্টিক ব্যবহার করি৷ এর মূল্যও কম৷ কাচের বোতল আর প্লাস্টিক বোতলের দাম এক নয়৷ তাই প্লাস্টিক প্রচণ্ড জনপ্রিয়৷ কিন্তু এর কুফলগুলো আমরা মাথায় রাখছি না৷ এর বিকল্পের ব্যবহার নিয়ে ভাবতে হবে৷ আগে মানুষ, তারপর প্লাস্টিক৷ সভ্যতার উন্নয়নে তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, সবাই তৃতীয় বিশ্বকে দোষ দিচ্ছে৷ চিন গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে প্রথম৷ তারপর যথাক্রমে আমেরিকা ও ভারত৷ কোনও একপক্ষ দায়ী নয়৷ তাই এর নিয়ন্ত্রণে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে৷ দৈনন্দিন জীবন চর্চায় পরিবর্তন আনতে হবে৷ সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে৷ বিশ্বে ফাইভ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর৷ ভোগবাদী জীবনচর্চা পরিহার করতে হবে৷ প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে আমাদের মধ্যে প্রচুর বিষ জমছে প্রতিদিন৷
৫. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গ্রাম ও শহরে কি একই রকম ভাবে পড়ছে?
পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ সি লেভেল বেড়েছে৷ খাদ্য নিরাপত্তা নেই৷ পানীয় জলও দূষিত হয়ে উঠছে৷ শহরের পরিবেশে যেমন এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, গ্রামের জীববৈচিত্র্য, ঋতুর উপরেও এর প্রভাব পড়ছে৷ বর্ষা ঠিকঠাক সময়ে আসছে ও যাচ্ছে না৷ শীত ও গ্রীষ্মে গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে৷ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের চরিত্র পালটে যাচ্ছে৷ ঋতুর বৈচিত্র্য নেই৷ অনেক ফসলই ঠিকমতো চাষ করা যাচ্ছে না গ্রামে৷ বিভিন্ন রোগ ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড ইত্যাদি বাড়বে জলবায়ু পরিবর্তনে৷ শহর বেশি ভুগবে এতে৷ তাই আমাদের আরও সাবধান হতে হবে৷
News Source: Faruque Ahamed