অঘ্রাণ মাসের সুঘ্রাণ – হেমন্ত-মরশুমের পরিসমাপ্তিতে পাকা ধানকে কেন্দ্র করেই তার কৃষি-সংস্কৃতি

0
960
Agriculture in India
Agriculture in India
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:7 Minute, 37 Second

অঘ্রাণ মাসের সুঘ্রাণ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী


১.
বাংলা পঞ্জিকাবর্ষের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণ। হেমন্ত-মরশুমের পরিসমাপ্তিতে পাকা ধানকে কেন্দ্র করেই তার কৃষি-সংস্কৃতি। অঘ্রাণ ক্ষেতে ‘মধুর হাসি’, ‘ফসলের সুবর্ণ যুগ’ নিয়ে আসে, আর তাই এ ‘লক্ষ্মীর মাস’। ব্রীহি ধানের উৎপাদন প্রাবল্যেই একসময় অঘ্রাণকে বছরের প্রথম মাস বা ‘মার্গশীর্ষ’ ধরা হত। বছরের আগে আসে বলেই অগ্রহায়ণ (অগ্র=আগে, হায়ণ=বছর); তার সংক্রান্তি বা সঞ্চারেও তাই ধান্যলক্ষ্মীর পারিপাট্য। এই সময়ে আকাশে ‘মৃগশিরা’ তারার চাহনি; সেই থেকেই ‘মার্গশীর্ষ’।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, “অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে খামারে লক্ষ্মী পাতিয়া চিড়া-মুড়কি, মুড়ি, মুড়ির নাড়ু, কলাই ভাজা পুজো হইয়াছিল।”

২.
রাঢ় অঞ্চলে হৈমন্তী ধান মাড়াই ও ঝাড়াই-এর শুভ পর্ব হিসাবে অনুষ্ঠিত হয় ইতুলক্ষ্মী ব্রত। কার্তিক সংক্রান্তিতে যে ইতু পুজোর সূত্রপাত, অঘ্রাণের রবিবারগুলিতে তার মেয়েলি আরাধনার পর অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে তার পরিসমাপ্তি। সেদিন ইতুর ঘট স্নান করিয়ে, দূর্বা-গাঁদাফুল-চন্দনে সাজিয়ে, নতুন আতপ চালে তৈরি মুঠোপিঠে নিবেদন করে উমনো-ঝুমনোর ব্রতোপাখ্যান শুনতে হয়। কাহিনীটি এক আত্মভোগসর্বস্ব ব্রাহ্মণের গল্প। পিতার দ্বারা বনে নির্বাসিতা হয়ে দুই বোন সূর্যদেবতার অনুগ্রহে সুখ-সম্পদ লাভ করে। ইতু আসলে ‘মিত্র’ বা সূর্যোপাসনা। ইতুব্রতের কথার সঙ্গে এইদিন পূর্ববঙ্গে পালিত চুঙী-ব্রতকথার প্রভূত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চুঙী-ব্রতকথা শুনতে হয় চুঙী বা নলগাছের পর্বমধ্য অংশে একুশ গাছি দূর্বা ও একুশ গাছি আলো চাল ভরে, হাতে নিয়ে।
ইতু ব্রতের মুঠো-পিঠে তৈরি হয় চালের গুঁড়ো, কলা, নারকেল,গুড় দুধে মেখে তার মন্ড করে। মন্ডগুলি হাতের মুঠোয় ডিম্বাকৃতি করা হয়, ভেতরে ভরা হয় একুশটি আতপ চাল, তা দুধে-খেজুর গুড়ে সেদ্ধ করা হয়। সংক্রান্তির পরদিন ভোরবেলা ইতু-সরা (নানান ফসলে/উদ্ভিদে পরিপূর্ণ নান্দনিক সরা) নদীতে বা জলাশয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। সরার গাছগুলি হল শুশনি, কলমি, কচু, ছোলা, মটর, মুগ, কলাই এবং যব। অঞ্চলভেদে তার পার্থক্যও চোখে পড়ে। ইতু পুজোর মন্ত্র এইরকম — “শুশনি কলমি লকলক করে,/রাজার ব্যাটা পক্ষী মারে/মারুক পক্ষী শুকোক বিল,/সোনার কৌটো রূপোর খিল,/গুটি গুটি চাদনের বাটি,/বেড়ার চাঁপাফুল/এই নিয়ে তুষ্ট হও/বাবা ইতু ঠাকুর,/ইতু ঠাকুরকে চাই বর,/ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর।”

৩.
অঘ্রাণ সংক্রান্তির দিনেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত ‘তুষ-তুষলী’। সারা পৌষ উৎযাপনের পর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। ধানের ভেতরের শস্যল-দানা বের হবার পর পরে থাকে তার হলদেটে-বাদামি খোসা। নতুন ধানের তুষ নিয়ে কালো গাই-এর গোবর মেখে তৈরি হয় বর্তুল — কোথাও ১৪৪টি, কোথাও ১২৪/৬২/৩১টি। এই গোবর-তুষলীর গুলির মাথায় গোঁজা হয় পাঁচগাছি দূর্বা। অঘ্রাণ সংক্রান্তির দিন কোথাও কোথাও কোনো ব্রাহ্মণ গুলিগুলোকে উৎসর্গ করে দেন; তারপর থেকেই তুষলীর পুজো শুরু হয়ে যায়। তুষ-তুষলীকে নারায়ণ ও লক্ষ্মী জ্ঞানে পুজো করে কুমারী মেয়েরা। পৌষ সংক্রান্তিতে তুষলীর মালসায় অগ্নিসংযোগ করে জলে ভাসিয়ে স্নান করে আসতে হয়। এই ব্রত করলে পিতৃ ও শ্বশুরকুলের সুখ-সমৃদ্ধি বাড়ে বলে বিশ্বাস। বাণিজ্যে বা প্রবাসে বসবাসকারী বাবা-ভাই-স্বামী-পুত্রের নিরাপদ জীবন ও প্রত্যাবর্তনের কামনায় অনেকে তুষ-তুষলীর ব্রত করেন।

রাঢ় বাংলার বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বর্ধমান, হুগলী জেলায় অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে শুরু হয় টুসু উৎসব। এই উৎসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু তার গান। মকর সংক্রান্তিতে টুসু বিসর্জন। প্রাচীন বাংলার তুষালি ব্রতই হয়তো টুসুতে পরিণত হয়েছে।

৪.
অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে শুরু হয় সর্বজয়াব্রত। প্রতি সংক্রান্তিতে এক একটি সামগ্রী বিপ্র-সাম্প্রদানিক বাক্যে ব্রাহ্মণকে উৎসর্গ করে সেই মাসে তার ব্যবহার থেকে বিরত হন ব্রতিনী। সেই হিসাবে অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে ব্রাহ্মণকে শাক প্রদান করা হয়। পরের বছর অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে এই ব্রতের সমাপ্তি। এইভাবে অন্যান্য দান সামগ্রীগুলি হল লবণ, তেল, সুপারি, পুষ্পমাল্য, অন্নভোগ, ধারাজল, দই বস্ত্র, চামর, ঘি এবং শয্যা।

৫.
সেঁজুতি ব্রতের সমাপ্তি অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে যা শুরু হয় কার্তিক সংক্রান্তিতে। এটি সান্ধ্যকালীন কুমারী ব্রত; আঙিনায় আলপনা ও প্রদীপ জ্বালিয়ে যার উৎযাপন। আলপনায় কামনাত্মক বাহান্ন রকমের ছবি আর মনস্কামনা পূরণের বাহান্ন ছড়ার আবৃত্তি — তাতে নারীজীবনের সুখ-দুঃখের অকপট অভিব্যক্তি। শিব, মন্দির, গঙ্গা-যমুনা, বাসগৃহ, গৃহস্বামী, রান্নাঘর, ঢেঁকি, তৈজসপত্র, গয়নাগাটি, গাছপালা প্রভৃতির আলপনায় গ্রাম-বাংলার বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। সাংসারিক সুখ-শান্তির জীবন কামনা এই ব্রত পালনের মূল উদ্দেশ্য।

সেঁজুত ব্রতের ছড়া — “সাঁঝ-পূজন সেঁজুতি/বারো মাসে বারো সতী/তার এক মাসে এক সতী/সতী হয়ে মাগলাম বর/ধনে-পুত্রে ভরুক বাপ-মা’র ঘর।”

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here