রাস-বিহারী হে গিরি-ধারী !!!
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ এর ”ব্রহ্মানন্দ-বল্লী”র সপ্তম্ অনুবাকে আছেঃ “রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লবধ্বানন্দী ভবতি।” পরমপুরুষ (বা ব্রহ্ম) এ রস আছে এটা নয়, তিনি নিজেই রস-স্বরূপ। আর, তাই দিয়ে তিনি “এষঃ হি এব আনন্দায়তি”….জীবকে আনন্দ দান করে চলেছেন। শ্রীমৎ ভগবদ্গীতা তে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন
” রসঃ অহম্ অপ্সু কৌন্তেয়……”।
এই ‘রস’ থেকেই ‘রাস’ শব্দের জন্ম….. যা’র আনন্দে এখন মেতে আছেন আপনারা সবাই। আর, দূরে থেকে বলছেন….
” বলয়া-নুপূর-মণি বাজয়ে কিঙ্কিণী
রাস রসে রতি রণে কী মধুর শুনি।”
বৈষ্ণবদের শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ভাব কে অতিক্রম করে সর্বোচ্চ যে ভাব….. তার নাম ‘মধুর’ বা ‘কান্তা-ভাব’। আর, কান্তাভাবে আরাধ্যের পরম-প্রাপ্তির নাম ই ‘মহা-রাস’। বৈষ্ণব পন্ডিত শ্রীধর স্বামী রাস এর সংঙা তে লিখছেন, “রাসো নাম বহু নর্তকীযুক্তে নৃত্যবিশেষঃ।” পদ্ম-পুরাণ এ শারদীয়া-রাস এবং বাসন্তী-রাস এর উল্লেখ পাওয়া গেলেও বিষ্ণু-পুরাণে কিন্তু রাস একটাই এবং তা শারদ রাস।
ভারত বিখ্যাত রাসোৎসব বৃন্দাবনে হলেও চৈতন্যদেব এর আমল থেকে তা বাংলার নবদ্বীপ, শান্তিপুর, বিষ্ণুপুর, মায়াপুর ছাড়িয়ে কোচবিহার হয়ে পৌছে গেছে ত্রিপুরা ও মনিপুরে।
যতদূর জানা যায়, শতাব্দী প্রাচীন কোচবিহার-রাস এর জন্মলগ্ন নাকি মদনমোহন দেবের নব-নির্মিত মন্দিরে প্রবেশ এর দিন। সাল টা ১৮৯০। এটি বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম মেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ্য ১৫ দিন এর ও বেশি সময় ধরে চলে এই মেলা। রাস-চক্র ঘুরানো এখানের ভক্ত ও দর্শনার্থীদের মধ্যে এক অন্যতম আকর্ষণ। মাননীয় জেলা সমাহর্তা এই মেলার স্থায়ী উদ্বোধক। লক্ষাধিক লোকের সমাগমে এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আসা ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভীড়ে ঠাসা এই মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসুখ হয়ে থাকে কোচবিহার-বাসী, সারাটি বছর।
মনিপুরে কিন্তু এই উৎসব এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে সকালে বসে “গোষ্ঠ-লীলা”র আসর যা চলতে থাকে বিকেল গড়িয়ে। ছোটো ছোটো সব বালক-বালিকারা, রঙবাহারী জরি- চুমকি বসানো ‘পলয়’ পরে, রাধা-কৃষ্ণ সেজে আনন্দে নাচ-গান করে। “গোপী-ভোজন” এর পরে সান্ধ্যাবেলায় মূল রাস-পর্ব শুরু হয়। এখানে সদ্য যুবক-যুবতীরা সুদৃশ্য ‘পলন’ পরে মাথায় নেয় ‘কুকুতম্বী’। এদের কোমরে থাকে সবুজ ঘাগরা। গায়ে থাকে এদের ছোটো-ছোটো আয়না বসানো সুন্দর পেটিকোর্ট। অন্যেরা যে যার তৈরি করা রং-বেরং এর বাহারী তাঁতের কাপড় পরেন। পুরুষেরা সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির সাথে ওড়না গায়ে আসেন উৎসব উপভোগ করতে।
অন্য জায়গাতে উৎসব আসার মুহূর্তে রাস-মঞ্চ তৈরি করা হলেও বৃন্দাবনের নিধুবনে তা কিন্তু স্থায়ীভাবে নির্মিত। প্রেমিক-ভক্তকুলের বিশ্বাস, ওখানে রাধা-কৃষ্ণের নিত্য রাস হয়। প্রতিদিন তাই, তাঁদের উদ্দেশ্যে রাসের শৃঙ্গার-সামগ্রী অর্পণ করা হয়। এই রেওয়াজ বহুবছর ধরে আজও চলে আসছে।
এদিকে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমল (ষোড়শ শতাব্দী) থেকে চলে আসা নদীয়ার রাস এর চরিত্র একদমই স্বতন্ত্র। এখানে একসময়ে বাড়িতে বাড়িতে পূজিত কয়েক শত প্রতিমাকে কাঁধে নিয়ে আনন্দে-উল্লাসে শাক্ত-রসের রাস-উৎসব পালন করতেন স্থানীয় মানুষজন। আপনারা যাকে Carnival বলেন, অনেকটা সেই রকমই। “সেকালের দারোগা কাহিনী” তে শ্রদ্ধেয় শিশির বসু লিখছেন, ” রাসপর্বে শান্তিপুরে যেমন রঙ্গতামাসা এবং বহু লোকের সমাগম হয়….দশভূজা, বিন্ধ্যবাসিনী, কালী, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্তি গঠিত হইত।”
শ্রী চৈতন্য পরবর্তী রাস এর রূপ কিন্তু পুরো আলাদা। এখানে সেব্য বলতে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ। আর শ্রীমতী রাধিকাই বলুন, ললিতা-বিশাখা-চিত্রা-ইন্দুলেখা আদি ‘অষ্টসখী’র কথা বলুন, ব্রজের সাধারণ নারীদের কথাই বলুন, এরা সবাই সেবক, সবাই ‘গোপী’। উপাখ্যানে পাওয়া যায়, শ্রীকৃষ্ণের ষোল হাজার এই সব সেবক/ সেবিকারা প্রত্যকে ই তাঁদের পূর্বাশ্রমে ছিলেন দন্ডকারণ্যের এক একজন ঋষি। এদের মনের বাসনা পূরণ করতে দ্বাপর কালে এই মিলন- উৎসবের আয়োজন। আবার, ভাগবত এর বাংলা তর্জমা থেকে এমনও পাওয়া যায়…..
“যখন করেন হরি বস্ত্র-হরণ
গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।
আগামী পূর্ণিমাকালে তাহাদের সনে
করিবেন রাস-লীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।”
অতএব, বস্ত্র-হরণ লীলা’র পরে শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের যে কথা দিয়েছিলেন, মহা-রাস এর মধ্য দিয়ে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটিয়ে তিনি তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। তাই, পৌরাণিক এই মহতী উৎসবের মধ্যে রঙ্গ-তামাসার যেমন কোনো সুযোগ নেই, ঠিক তেমনি কোনো বৈদিক সত্যকে খুঁজে পাওয়াও নিতান্ত সহজ নয়।
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.