বিসর্জন (ছোটোগল্প)
হীরক মুখোপাধ্যায়, কলকাতা
আজ বিজয়া দশমী, বিকেল তিনটে থেকেই চারদিকে একটা হইহই রইরই ব্যাপার। বছরের অতিবিশেষ আনন্দ মুহুর্তকে মনের মণিকোঠায় স্বর্ণাক্ষরে বাঁধিয়ে রাখার জন্য আজ কোলকাতা থেকে এসেছে সুনেত্রা।
ওলা ডাকবাংলো মোড়ে পৌঁছতেই গাড়ির ভেতর থেকে সেকেণ্ড ইয়ার এমবিবিএস পড়ুয়া সুনেত্রা দেখতে পেল, পি সি চন্দ্র জুয়েলার্স-এর গেটের সামনে ডেনিম ব্লু ফেডেড জিন্স আর জেটব্ল্যাক ফুল স্লিপ জামা পরে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে রাজ।
অনেকদিন বাদে প্রেমিককে সামনে পেয়েই কলকল করে উঠল সুনেত্রা, “হাই রাজ! আ’ম হিয়ার।”
আওয়াজটা কানে আসতেই রাজ দেখতে পেল পিঁয়াজ রঙা বেনারসি শাড়ি পরে ওলা থেকে নামছে সুনেত্রা।
“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম টু বারাসাত, ডার্লিং।”
ব্যস্ত চৌরাস্তার একপাশে রাখা রয়েছে রাজ-এর সদ্য কেনা চারচাকা গাড়ি। সুনেত্রা-র সাথে দেখা হতেই ওর হাত ধরে রাজ এগিয়ে চলল গাড়ির দিকে।
“ইজ দিস ইয়োর নিউ কার লোল ?”
“ইয়া।”
“হাউ নাইস, বিলিভ মি ইটস মাই ফেভারিট কালার !”
ডোর কি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে রাজ বলল, “থ্যাঙ্কস ফর ইয়োর কমপ্লিমেন্ট।”
রাজ ভেতরে উঠে দরজা খুলে দিতেই হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে পড়ল সুনেত্রা। সুনেত্রা গাড়িতে ওঠা মাত্র ‘টেম্পটেশন’-এর সুবাসে আমোদিত হয়ে উঠল গাড়ির ভেতর।
কোলাহলের একটু আড়ালে গাড়ির ভেতরে সুনেত্রার দিকে বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে রাজ বলল, “কাপড়টা তোমার গায়ে বেশ মানিয়েছে।”
“মা’র কাপড়।”
সুনেত্রার কথা কানে যেতেই ফিক করে হেসে রাজ বলল “সে তো বুঝতেই পারছি।”
কথা চলাকালীন গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল রাজ। যশোর রোড ধরে ধীরে এগিয়ে চলল গাড়ি। গাড়ির ভেতর হালকা চালে চলছে রবীন্দ্র সঙ্গীত।
চনমনে মেজাজে গাড়ি চালাচ্ছিল রাজ। কিন্তু শান্তিতে নতুন কেনা গাড়ি চালানোরও উপায় নেই। পাশে বসে সুনেত্রা ওর ছুঁচলো নখ দিয়ে রাজের বাম থাইয়ে সমানে চিমটি কেটে চলেছে।
“উফ্ বাচ্চাদের মতো কী শুরু করলে ?”
“তুমি সবসময় বস্তার মতো এরকম প্যান্ট কেনো পরো বলতো ?”
“তোমার নখের বিষ থেকে বাঁচব বলে..”
“খবরদার বলছি! ফালতু কথা বলবেনা একদম। ভালো করে তাকিয়ে দেখো আমার নখের ভেতর কোনো ময়লা নেই।”
ওদের খুনসুটি চলার ফাঁকে গাড়ি দক্ষিণপাড়া, হাটখোলা পেরিয়ে শেঠপুকুর সংলগ্ন শিবানন্দ ধামের সামনে পৌঁছলো। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বারাসাত শাখাকে সবাই ‘শিবানন্দ মঠ’ বলতেই অভ্যস্ত। মঠে দুর্গাপুজোর আজ শেষদিন, তাই ভক্ত সমাগম ভালোই হয়েছে এখানে।
(২)
সাধু সন্ন্যাসীদের দুই চোখে দেখতে পারেনা রাজ। সবসময় ওর মুখে এককথা “যত সব ভণ্ড, একজনও যোগী নেই সব ব্যাটা ভোগী। এদের সবকটাকে সারিবদ্ধ করে পেটানো উচিত।”
পারতপক্ষে কোনো মঠ মিশনের ছায়াই মারাতে চায়না রাজ। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন-এর প্রাক্তন সংঘাধ্যক্ষ শিবানন্দ পূর্বাশ্রমে থাকাকালীন যে সরকারী বিদ্যালয়ে পড়তেন, সেই বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করলেও বর্তমান সাধুসন্ন্যাসীদের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের জন্য ভুলেও মঠ মিশনে ঢুকতে চায়না ও। যদিওবা কখনো যায়, তখন যায় ‘মহেশানন্দ’-র মতো ভণ্ড কামাচারী সাধুদের খবর ফাঁস করতে।
আজ রাজ অসহায়। ওর বাবা মা আগেই চলে এসেছে শিবানন্দ মঠে। এখানকার প্রতিমা বিসর্জন না দেখে ওঁনারা বাড়ি ফিরবেননা।
শিবানন্দ মঠ আর বারাসাত হেড পোস্ট অফিসের পাশের একফালি সরু গলিতে গাড়িটা ঢুকিয়ে রাজ মোবাইলে ওর মাকে ধরল, “তোমরা কোথায় ?”
উত্তর এল, “এই তো ভেতরে।”
“ধানাই পানাই কতক্ষণ চলবে ?”
“এই তো হয়ে গেছে, এবার যাত্রা শুরু হবে। ও এসেছে, তুই কোথায় ? “
“হ্যাঁ, ওকে নিয়েই পাশের গলিতে অপেক্ষা করছি।”
কথাটা শেষ হবার আগেই কান ফাটানো ঢাকের আওয়াজে গাড়ির ভেতরেও বসে থাকা দায় হয়ে উঠল। গাড়িতে বসেই দেখতে পেল একদল বয়োবৃদ্ধ ভক্তদের সামনে রেখে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভেতর থেকে প্রতিমা সহ শোভাযাত্রা রাস্তায় উঠল।
রামকৃষ্ণানুরাগী ভক্তবৃন্দ প্রতিমা নিয়ে ওর গাড়ির দিকে যতই এগোতে লাগল, গাড়িও ততই লাফাতে লাগল। কী হচ্ছে বোঝার জন্য পাশে তাকাতেই রাজের ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। ও দেখতে পেল, দুহাত মাথার উপরে তুলে সুনেত্রা কোমর ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গাইছে, “ঢাকের তালে কোমর দোলে..।”
চোখের সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল শেঠপুকুরের দিকে। প্রশাসনের তরফ থেকে বিসর্জনের জন্য বারাসাতের যেকটা পুকুরকে চিহ্নিত করা থাকে তারমধ্যে শেঠপুকুর অন্যতম।
ওদের গাড়িকে অতিক্রম করে শোভাযাত্রা রবীন্দ্রভবনের দিকে এগোতেই মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল রাজ।
রাজের ব্যাজার মুখ দেখে সুনেত্রা জানতে চাইল, “অ্যাই, তোমার আবার কী হলো ?”
সুনেত্রার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে হেসে ফেলল রাজ, “কাণ্ড দ্যাখো এদের! একে তো ভক্তদের ঘাড় মটকে পুজো করবে, তারপর আবার ওঁদেরই ঘাড়ে চড়িয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়াবে…”
“তাতে তোমার কী! পরমহংসের মতো শুধু দুধটুকুই খাওনা বাবা; জলটুকু না হয় পড়ে থাক।”
ইঞ্জিন চালু হতেই গাড়ি রাস্তায় তুলে গতি বাড়াল ও। একনাগাড়ে হর্ণ বাজাতে বাজাতে শোভাযাত্রাকে পেছনে ফেলে শেঠপুকুর শনি মন্দিরের পাশে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল রাজ।
ওর গাড়ির সামনে প্রেসের স্টিকার লাগানো, তাই কোনো সমস্যা নেই; নচেৎ এই সময়ে পুকুরের পাশে কোনো গাড়ি ঢুকতেই দেয়না স্থানীয় পুলিস।
ওরা যখন শেঠপুকুরের সামনে পৌঁছল তখন ওখানে এক গৃহস্থ বাড়ির দুর্গাপুজোর নিরঞ্জন পর্ব চলছিল। পেছনে এসে হাজির হয়েছে রামকৃষ্ণ মঠের মাতৃ প্রতিমা।
ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ির দুদিক দিয়ে দুজনে বাইরে বেরিয়ে এসে পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে পুকুর পাড়ের দিকে এগোতে যেতেই রাজ অনুভব করল পেছন থেকে ওর পিঠে কেউ হাত রেখেছেন।
পেছন ফিরে ও তাকিয়ে দেখল মঠের এক গৈরিকধারী সন্ন্যাস ওর পিঠে হাত রেখে মিটিমিটি হাসছেন।
রাজও একমুখ মিস্টি হাসি উপহার দিয়ে জানতে চাইল, “ভালো আছেন মহারাজ ?”
“ভালো আর রাখলে কই !”
“কেনো! আমি আবার কী করলাম ?” অবাক হয়ে জানতে চায় রাজ।
“তোমাকে কতো করে বললাম কুমারী পুজোর দিন এসো, আমাদের অনুষ্ঠানটা তোমার কাগজের হয়ে তুমি পরিবেশন করো। তুমি তো এলেইনা, ভালো লাগে বলো !”
মহারাজের কথা শুনে মুখে স্মিত হাসির রেশ টেনে মহারাজের উদ্দেশ্যে কপট বাক্যবাণ প্রয়োগ করে রাজ টিপ্পনী কাটল, “দেবী পুরাণে পড়েছিলাম, অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে দুর্গাপুজোর সময় সুলক্ষণ যুক্ত কোনো কুমারীকে চয়ন করে তাকে নব্য বস্ত্র ও অলঙ্কার পরিয়ে ভক্তিভরে তাকে যথাসাধ্য পুজো করাই সাধকের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য।
কিন্তু আপনাদের দেখি সবই উল্টো পুরাণ। যে বাচ্চা মেয়েগুলোকে আপনারা পুজো করেন, তাঁদের কাউকেই আপনারা নিজেদের গ্যাঁটের টাকায় নতুন শাড়ি, গয়না কিনে দেননা, ওদের অভিভাবকরাই নিজেদের সামান্য মানসিক সুখ প্রাপ্তির জন্য নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ ধ্বংস করে নতুন শাড়ি, গয়না কিনে সেসব বাচ্চাগুলোকে জোর করে পরিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে আপনাদের সামনে নিয়ে আসেন।
এতে যে আপনাদের মতো সাধকদের কী লাভ হয় সেটাই আমি বুঝিনা। এইরকম ফাঁকির পুজো নয় নাই করলেন মহারাজ। আপনাদের সবার নামের পেছনেই আনন্দ জোড়া আছে। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, পুরাণের নির্দেশ অমান্য করে সত্যি কী আনন্দ অর্জন হয় ?”
রাজের কথা শেষ হতেই ঘাটে আনন্দের তাল কেটে গেল। চারদিক দিয়ে রাজের কানে ভেসে আসতে লাগল চাপা গুঞ্জনের সঙ্গে বেশ কিছু কটূক্তি।
“দেখতে সুন্দর হলে হবে কী পুরো মাকাল ফল। পুঁথিগত বিদ্যাটাই আছে প্রকৃত শিক্ষা কিছুই নেই।”
কোনো ভক্ত আবার অপরকে বলছেন, “ও নিজেকে যে কী মনে করে ভগবান জানেন…, আরে বাবা রামকৃষ্ণ মঠ ডাকলে দেশবিদেশের মার্কামারা সাংবাদিকরা নিমেষে ছুটে আসে আর একে দেখো !”
কেউ কেউ আর একটু এগিয়ে বলতে লাগল, “মনে হচ্ছে দিই কানের গোড়ায় একটা…।”
রাজ আড়চোখে চেয়ে দেখল ওর মা বাবা মুখ নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুনেত্রাও কখন যেন ওর হাত ছেড়ে দিয়ে মাটির দিকে আরক্তনয়নে তাকিয়ে আছে।
এইসব উটকো ঝামেলা কীভাবে নিমেষে মেটাতে হয় কর্মজগতে প্রবেশ করার পর এতদিনে সেটা ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছে রাজ।
চোখের সামনে ও রোজ দেখে মব সামলানোর সময় পুলিস হাতের সামনে ছেলে বুড়ো যাকে পায় তার উপরেই চোখ কান বুঁজিয়ে প্রথম আক্রমণ শুরু করে। আর একটার উপর রামপ্যাঁদান শুরু করলেই বাদবাকি সবাই চোখের পলকে পিছু হটতে থাকে।
যে ভদ্রলোক ওর কানের গোড়ায় কিছু প্রয়োগ করার উস্কানি দিচ্ছিল রাজ সরাসরি তাকেই ধরল।
“এই যে মশাই এই মহারাজকে আপনি চেনেন ?”
রাজের প্রশ্নের ধরণ দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন ওই ভদ্রলোক। “কেনো চিনবনা, তোমার কাছে ওঁনার কোনো মর্যাদা না থাকতে পারে; কিন্তু জেনে রাখো উনি আমার গুরুদেব।”
“তাহলে আপনিই বলুন, আপনার গুরুদেবের সাথে যদি কেউ শাস্ত্রালাপ করতে চায় সেটা কী পাপ না অপরাধ ! কেউ শাস্ত্রালাপ করতে চাইলে তার কানের গোড়ায় আঘাত করার মন্ত্র দিক্ষাই কী একদিন আপনার কানে দিয়েছিলেন এই গৈরিকধারী সন্ন্যাসি ?”
রামকৃষ্ণ মঠের সাথে যাঁরা যুক্ত তাঁরা সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায় বলে সবসময় নিজেরা একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন।
তাই সকলের সামনে রাজের বেয়ারা প্রশ্নের মুখে পড়ে উত্তরের অভাবে তোতলাতে শুরু করলেন ওই বয়স্ক ব্যক্তি।
“ও মা! শাস্ত্রালাপ পাপ হবে কেনো ?”
“প্রশ্নের অন্তর্নিহিত ভাবটা না বুঝে আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এই মুহুর্তটাকে আপনি বিষিয়ে দিলেন কেনো ?
“মা-মানে ?”
“আরে বাবা আমি আপনার গুরুদেবের সামনে ধর্ম জিজ্ঞাসা রেখেছিলাম। তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি উত্তর দিতেন, নাহলে উত্তর দিতেননা। মাঝখানে নাক গলিয়ে আপনারা জনসমক্ষে ওঁনাকে এভাবে লজ্জিত করলেন কেনো ? মনে রাখবেন অতিভক্তি অনেক সময়…”
আরো কিছু বলতে চাইছিল রাজ, তার আগেই ওকে বুকে টেনে নিলেন মহারাজ।
বুকের মধ্যে রাজকে জড়িয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে মহারাজ বললেন, “এই জন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে রাজ। তুমি যাকে ঝাঁকাতে শুরু করো সে বুঝতেই পারেনা পূর্ণ থেকে কখন সে তার নিজেরই অজান্তে শূন্যে এসে পৌঁছেছে। জ্ঞান জগতে পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধে থাকা অবিদ্যা রূপী মলিনতাগুলো দূর করার পদ্ধতিটা এর মধ্যেই কিন্তু তুমি বেশ সুন্দর আয়ত্ত করে ফেলেছ।”
“আমার কথায় আহত হলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন মহারাজ।
এই বছর কুমারী পুজোর দিন খবর সংগ্রহের জন্য আমাকে বেলুড়মঠে পাঠানো হয়েছিল। ওখানে জনৈক কুমারী-র মা’ই আমাকে অভিযোগগুলো জানিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম এই বিষয়ে সবার আগে আপনার মুখ থেকেই কিছু শুনব..।”
“দূর বোকা! তুমি কী দোষ করেছো যে ক্ষমা করব। চলো চলো মায়ের পায়ে হাত দিয়ে আগে প্রণামটা সেরে ফেলি।”
মহারাজ আর রাজ একযোগে মাতৃ প্রতিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার পরেই ভক্তগণ ‘আসছে বছর আবার হবে’ বলতে বলতে মাকে জলে শুইয়ে দিয়ে চারদিকে শান্তির জল ছেটাতে লাগলেন।
শেঠপুকুরে পশ্চিমমুখো হয়ে মাকে বিসর্জন দিতে হয়। মাকে বিসর্জন দেওয়ার পর অস্তাচলগামী সূর্যকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে মাথাটা একটু তুলতেই একটা দৃশ্য নজরে এল। ওখানেই আটকে গেল রাজের দৃষ্টি। ও চেঁচিয়ে উঠল, “মহারাজ!”
মহারাজ ওর দিকে ভাবুক নয়নে তাকাতেই রাজ বলল, “ফলো মি, ক্যুইক।”
কথাটা বলেই কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই উর্ধশ্বাসে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করল রাজ।
বিসর্জন ঘাটে উপস্থিত রামকৃষ্ণানুরাগী ভক্তবৃন্দ তাঁদের নিজ চর্মচক্ষে দেখলেন রাজের পেছনে পেছনে বাধ্য শিষ্যর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছেন শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসী মহারাজ।
মহারাজকে ওভাবে পাগলের মতো ছুটতে দেখে পেছনে পেছনে পুকুরের অপর পাড়ে পৌঁছে গেলেন বেশকিছু ভক্ত। ভক্তরা পুকুরের ও’পাড়ে গিয়ে দেখলেন দশটা কুকুরের মাঝে পড়ে থাকা এক বৃদ্ধার মাথা কোলে তুলে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে রাজ। মহারাজ রাজের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পরমস্নেহে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
মহারাজ আর রাজকে পুকুরপাড়ে ওই অবস্থায় দেখে মহারাজের শিষ্য জানতে চাইলেন, “কী হয়েছে মহারাজ আপনারা এরকম করছেন কেনো ?”
বেশকিছু কৌতূহলী ভক্তবৃন্দের কৌতূহল নিরসন করতে মুখ খুললেন সন্ন্যাসী মহারাজ, ” ক’দিন আগে রাজই প্রথম এঁনাকে এই চত্বরে দেখতে পায়। ওর কাগজ এঁনাকে নিয়ে মর্মস্পর্শী একটা খবরও প্রকাশ করে। তার পরেই আমি ঘটনাটা জানতে পারি।
এঁনার নাম দুর্গাদেবী। একসময় ঘরে ঐশ্বর্যের অভাব ছিলনা, অথচ ভাগ্যদোষে পথের ভিখারী রূপেই আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
স্বামী মারা যাওয়ার পর এঁনার সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলেরা প্রথমে ওঁনাকে জোর করে একটা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, পরে ওঁনাকে ওখানে রাখতেও ওঁরা নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে।
কিন্তু দৃপ্ত মা ভেঙে পড়েননি। হাসতে হাসতে পথকেই আপন করে নিয়েছিলেন।
নিজের সন্তানদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত হয়ে বুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন রাস্তার দশটা বেওয়ারিশ কুকুরকে। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের দশটা নামকরণও করেছিলেন।
রাজ ওর পরিচিত কয়েকটা হোটেল মালিককে বলে হোটেলের বেচে যাওয়া প্রত্যেকদিনের খাবার নির্দিষ্ট সময় কুকুরগুলোর জন্য দুর্গাদেবীর হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। আমাকেও বলেছিল মঠ থেকে প্রত্যেকদিন দুর্গাদেবীর আহারের ব্যবস্থা করে দিতে। কিন্তু আমি অতি অভাজন, আমার আনা কোনো আহার্যই উনি মুখে তুলতেন না। শুধুমাত্র জল খেয়েই কাটিয়েছেন শেষ কটা দিন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজে না খেলেও নিজের মুখের আহারগুলো তুলে দিতেন সন্তানসম এই প্রাণীগুলোর মুখে।
আজ এদের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন এই মা। নিজের সন্তানরা তাঁদের জন্মদাত্রী মা’কে খোলা রাস্তার বুকে একা ফেলে রেখে গেলেও, তাঁর আশ্রিত দশটা কুকুর কিন্তু দুর্গাদেবীকে ছেড়ে চলে যায়নি। ওরা সন্তানের মতোই মা’র চোখের সামনে ঘুরে বেড়াত।
আজ নিরঞ্জনের দিন যখন তোমরা মাতৃ প্রতিমাকে জলে ভাসিয়ে দিলে, তখন ঘাটের অপর পাড়ে সন্তানসম এই দশটা প্রাণীর চোখের সামনে এই দুর্গাদেবী নিজেও জলশয্যা নিলেন।
মাটির তৈরী মাতৃ প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে মানুষ কী পায় বলো ?
কিন্তু দ্যাখো, রক্তমাংসের দুর্গাদেবী আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর সন্তানসম ‘দয়া,’ ‘মায়া,’ ‘করুণা,’ ‘ক্ষমা,’ ‘শ্রদ্ধা,’ ‘ভক্তি,’ ‘প্রীতি,’ ‘শান্তি,’ ‘মঙ্গলা,’ আর ‘চেতনা’ নামের এই দশটা প্রাণকে। এরাই আমাদের সম্পদ। বিসর্জনের এই তিথিতে সর্বশক্তি দিয়ে এই দশটা শক্তিকে আমাদের হৃদয়ে গ্রহণ করতে হবে। এই শক্তিগুলোই আমাদের সারা বছরের পাথেয়।” কথাগুলো বলতে বলতে রাজের কাঁধে মুখ রেখে বাচ্চার মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মহারাজ। সন্ধার মরা আলোয় বিষণ্ণ হয়ে উঠল পরিবেশ। মা যে চলে গেলেন।
ডিজিটাল আর্ট :সুমন মুন্সী
হীরক মূখোপাধ্যায় শুধু একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক শুধু নন, নানা বিষয়ে বুৎপত্তি ও প্রতুৎপন্নমতির অধিকারী। তার কলম বহুবার বহু জীবন কে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে এমন বিষয় কে তুলে ধরেছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে সাংবাদিকতার চলন্ত অভিধান এমনই তাঁর কলমের জাদু। আইবিজি নিউজ এর প্রথম দিন থেকে পৃষ্ঠপোষক ও প্রয়োজনে অভিভাবক রূপে দিশা নির্দেশ করতে সব সময় রাজি ।