পুরোহিতের জীবন – প্রদীপের তলায় অন্ধকার
সুমন মুন্সী, কলকাতা
সনাতন ধর্মের রক্ষা নিয়ে যারা খুব চিন্তিত,হিন্দুদের পায়ের তলায় মাটি নেই বলে গলা ফাটিয়ে মাঠে ময়দানে তুফান তোলেন তাদের কুম্ভিরাশ্রু দেখলে লজ্জা লাগে ।
আসুন দেখি কত অসহায় হয়ে পড়ছে হিন্দুদের পুরোহিত সমাজ ।
১. বংশ পরম্পরায় পুরোহিত ও যজমান সম্প্রদায় নিজেদের ছেলে মেয়ে কে আর এই কাজে দিতে চাননা । ঈশ্বর বিশ্বাসে ঘাটতি নেই কিন্তু মানুষের ব্যাবহারে তাঁরা এই পেশা ছেড়ে দিতে চান। দুর্মূল্যের বাজারে সবই বাড়ছে শুধু বাড়েনা দক্ষিনা। সবার একটাই কথা পুজোয় পুরোহিতের প্রচুর ইনকাম। সাথে ফল মিষ্টি শাড়ি । কিন্ত কে বোঝাবে কুড়ি লাখ টাকার বাজেটে কমিটি থেকে পুরোহিতের বরাদ্দ চারটে লাল পাড় সাদা শাড়ি । সেটাও যতটা জ্যালজ্যালে হয় । গামছার সাইজ রুমালকেও লজ্জা দেবে । এর মধ্যে আবার যেসব শাড়ি আসে তার মধ্যে কমিটির নির্দেশ কিছুগুলো রেখে দেবেন ।
২.সব কমিটিতে দু একজন মাতব্বর থাকে । অষ্টমীর দিন দক্ষিণা কমিটি নিয়ন্ত্রণ করবে । এইভাবে পাঁচ দিনের পুজো শেষ করে শর্ত অনুযায়ী সামান্য কিছু টাকা আর রাজ্য সরকারের দেওয়া রেশনের ফ্রি নিম্নমানের চাল রুমালের থেকেও ছোট গামছা আর গোটা চারেক ভালো শাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরা । সন্তানের লেখাপড়া, বাপ্ মায়ের চিকিৎসা, সংসারের প্রয়োজন এরপর রাম ভরসায় ।
যখন সবাই পুজোয় বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করছে তখন পুরোহিত মন্দিরে উচ্চ কন্ঠে খালি পেটে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন । যাঁরা ভাবেন অ বং করেই ইনকাম তাদের বলব ঐ তিন ঘন্টা করেই পাঁচদিন খালি পেটে অং বং করেই দেখান । করে দেখান দেড় ঘন্টার মহা হোম । খুব উচ্চ কন্ঠে নয় স্বাভাবিক গলাতেই চণ্ডীপাঠ করে দেখিয়ে দিন ।
তাই এসব মেনে নিয়েও পুরোহিতের মা , বৌ মনোকষ্ট বুকে চেপে প্রত্যাশায় থাকে পুজোর পর বাড়ি ফেরার দিকে । ফিরতেই পাড়ার কথা “ভালোই কামাই” হল, যেন লুটের মালের বখরা নিয়ে ফিরছে । এতই যদি অসম্মান তবে কেন পূজার সময় পুরোহিত খোঁজ করো। কেউ বলবে নারকোল খাওয়ালি না, কেউ বলবে দুটো গামছা দিস বা শাড়ি দিস । প্রচুর তো ঝাড়লি এ কদিনে।
৩. তারপর আছে যদি দাঙ্গা বাধে, সবার আগে তার পরিবার হয় টার্গেট, কারণ সমাজ জানে সে হিন্দু পূজারী চক্রান্ত সহজ হয় এদের আঘাত করলে ।
৪. মেয়ের বিয়ের সময় শশুর বাড়ি বলবে প্রণামী ৫০ টা, পুরুত মানুষ আপনার কি খরচ পুজোয় তো ভালোই পান । কিন্তু পুজোয় পাওয়া সেই শাড়ি দিলে, মেয়ের শাশুড়ি, বাবার কিপ্টে হওয়ার খোঁটা দেবেই দেবে ।
৫. সত্যনারায়ণ, লক্ষী পূজা, স্বরসতী পূজা আর সব বাড়িতে হয়না| আবাসন ভিত্তিক একটি পূজা যতটা কম দিলে হয়। মার্সেডিজ গাড়ি চড়তে পারি কিন্তু পুরুত রিক্সা ভাড়া চাইলে , চামার বলে গালি দেবে মনে মনে ।পুরোহিতের জীবনের এই শারীরিক ও মানসিক কষ্ট এদের চোখে পড়ে না । যখন কেউ সরকারি মোটা বোনাস পায় বা অনান্য পেশায় প্রচুর টাকা আয় করে, তখন বলে না ভালোই তো টাকা কামালি, কিছু দে । বা এরাই কখনও পুরোহিতকে বলে না, ঠাকুরমশাই এই নিন পুজোর সময় কিছু রাখুন, আপনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার মানুষ ।
এরা সবসময়ই উদাহরণ দেয় কালীঘাট, তিরুপতি বা জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতের আয়ের সাথে তুলনা করে । কিন্ত অধিকাংশ পুরোহিতের জীবন কত কষ্টের সে তারাই জানে ? পুরোহিত সবার মঙ্গল কামনা করে অথচ উপবাসে চিৎকারে লিভার ও হার্টের অকালেই বারোটা বাজায় । এমনও দেখেছি বাড়িতে মাসিক আয় দেড় লাখের উপর । নারায়ণ পুজোর দক্ষিণা একান্ন টাকা । বাড়াতে বললেই একটা পরিচিত শব্দ “পুরোহিত লোভী” । পুরোহিতকে এক টাকাতেও সন্তুষ্ট হওয়া উচিত । অসন্তুষ্টা দ্বিজাঃ নষ্টা, হ্যাঁ পুরোহিদের পেট, পিঠ , রোগ, পোশাক কোন কিছুই নেই । অথচ এইসব বুদ্ধিজীবীরা যখন কোন নার্সিংহোম অতিরিক্ত টাকা নেয়, তখন কিছু বলতে পারে না । স্কুলে ডোনেশান নিলেও চুপ । ওগুলো লোভ নয় ।
৬. এরপর অসম্মানের পুরোহিত ভাতা ভোগীর তকমা, হ্যাঁ এটাই সমাজ । আর এটাই তার বিচার । যখন কোন ব্রাহ্মণ পদবীধারী (?) এসব কথা গুলো বলেন, তখন এদের পিতৃ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ করেন কেউ । পুরোহিত ভাতা মারছিস তো এত কথা কিসের? কে বোঝাবে, ওই এক হাজার টাকা পেতে গেলে, একটা অতি মূর্খ ধূর্ত কোনো রাজনৈতিক নেতার পায়ে তেল দিতে হবে । তাই আমার মতো অধিকাংশ পুরোহিতের আজও সেটুকু জোটেনি । এসব শুনলে সত্যিই পুরোহিত হিসেবে নিজের লজ্জা লাগে ।
যারা আজ বাংলাদেশের দূর্গা পূজায় তান্ডব নিয়ে চিন্তিত, তারাও কি এক নীরব সন্ত্রাস ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রয়াস করছেন না পুরোহিতদের ক্ষেত্রে। ভেবে দেখুন তো আপনি নিজে পূজা করবেন না চেষ্টাও করবেন না তবে যে মানুষ গুলো আজ আপনার সংকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখছে তাঁদের ওপর কেন এই অত্যাচার, সুধী আপনার অভিজ্ঞতা কি বলে?
৭. সংস্কৃত উচ্চারণ স্পষ্ট নয়, অংবং চং করে কামাই, বলার আগে নিজে সেই মন্ত্র সঠিক উচ্চারণ করে দেখান, পুরোহিতদের জন্য সংকৃত চর্চার জন্য অনুদান দিন, স্কুল টোল চালু করুন ।
৮.কোনো পুরোহিতের কাজ পছন্দ না হলে, পরেরবার ডাকবেন না। আর পুরোহিতরা নিজেদের সঙ্গবদ্ধ করে সমকাজে সমদক্ষিনার দাবি সারা ভারত জুড়ে চালু করুন । এর জন্য নিজেদের মধ্যে ট্রেনিং ও সার্টিফিকেশন চালু করে সঠিক পুরোহিতদের অনলাইন বুকিং ব্যবস্থা চালু হোক । এতে অযোগ্য পুরোহিত দূর হবে সঠিক পূজা চালু হবে আর যজমান ও জানবে কোন পূজায় কি খরচ।
প্রদীপের নিচে অন্ধকার, হিন্দু সামাজই হিন্দুদের শেষের রাস্তা তৈরী করছে, অন্যদের দোষ দেবার আগে নিজেরা আমাদের সনাতন সংকৃতির রক্ষা করি।
হিন্দুসমাজ পারস্পরিক শ্রদ্ধায়, সম্মানে সকল বর্ণের মানুষকে সম্মান সহ কাছে ডেকে নেই । আসুন অভিন্ন পৌরোহিত্য সুরক্ষা ব্যাবস্থা গ্ৰাহক আর এর দাবি প্রধান মন্ত্রী কে জানানো হোক ।
Inspired by and reference from Facebook Post