শতরূপা তোমাকে কিছু বলার ছিল সুমনের (তৃতীয় ভাগ) – ছেত্রীদার দার্জিলিং আর সুমনের ছেলেবেলা
(আগে যা হয়েছে জানতে ক্লিক করুন প্রথম ভাগ , দ্বিতীয় ভাগ, তৃতীয় ভাগ, চতুর্থ ভাগ,পঞ্চম ভাগ,ষষ্ঠ ভাগ, সপ্তম ভাগ, অষ্টম ভাগ, নবম ভাগ)
বিল্টুর ফোন রেখে পার্থ ভাবতে বসলো, কি করা যায়।
বিল্টু পুরো বন্ধুদের পরিবার নিয়ে আসছে, পার্থ সমাজপতি দার্জিলিঙের স্কুলে ফিজিক্সের ডিপার্টমেন্ট হেড, সব অনলাইন ক্লাস গুলো ওর ডিসাইন করা। ৬-১২ প্রতি ক্লাসে ৫০ জন করে ছাত্র, এক একটি ক্লাসে ৫টা সেকশন মানে পুরো ১৫০০ বাচ্ছার টার্ম এক্সাম সামনেই। খান স্যার এর মা অসুস্থ কলকাতায় রয়েছেন ছুটিতে। বিপ্লব বাবু ভালো মানুষ ছাত্র বিপ্লবের সামনে অসহায়। অথচ এতো গুলো স্টুডেন্টের দায়িত্ব অস্বীকার করা কোনো টিচারের পক্ষে সম্ভব নয় । তারপর পার্থ টিচার হিসাবে আন্তরিক একথা সহকর্মী,ছাত্ররা এবং তাদের অভিভাবকরা সকলেই জানে এবং এই জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মানও করে।
“কি ভাবছেন, স্যার। বিশেষ চিন্তিত লাগছে “, প্রশ্ন করলো কেমিস্ট্রির হেড টিচার মনি ছেত্র্রী, গুর্খা ছেলে, কিন্তু চমৎকার বাংলা বলেন, প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিলেন পরে, রাজাবাজার থেকে কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এমটেক । মোটা মাইনের চাকরি সহ বিদেশ যাত্রা নিশ্চিত ছিল । কিন্তু দেশ তথা নিজের শহর দার্জিলিং কে প্রান দিয়ে ভালোবাসে । গুর্খা রাজনীতির সক্রিয় সদস্য, কিন্তু সংকীর্ণতা নেই, অধিকারের দাবি জানায় যুক্তির আলোয়। শোনা যায় ছোটবেলায় অনেক কষ্টে কেটেছে। বাবা কলকাতায় সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন, এক চা বাগানের মালিকের বাড়িতে,। তবে সেই মালিকের সাহায্যেই তাঁর লেখাপড়া । আজও খুব শ্রদ্ধা করেন বুড়া বাবু কে ।
“ছেত্রীদা, ধর্ম সংকটে পরে গেছি”, পার্থ বললো।
“কেন কি হয়েছে?”
এবার মনাস্ট্রিতে সুমনের মতো কাউকে দেখতে পাওয়া, ছেলেবেলার বন্ধুর এক্সিডেন্ট, এরপর তিস্তায় জীপ্ ভেসে যাওয়া । ডেড বডি না পাওয়া, শুধু একটা ব্যাগ আর রক্তমাখা প্রেস আইডেন্টি কার্ড খঁজে পাওয়া এবং অনেক খানা তল্লাশি করে পুলিশ ও বনদপ্তর এটাই সাব্যস্ত করে, বন্য জন্তুর কাজ ।
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে চলে পার্থ। কোনো দিনও আবেগে ভেসে যাওয়ার লোক পার্থ নয়, এটাই সবাই জানে। কিন্তু ও যে আসলে চাপা ভিতরে গুমরে মরে, এটা কেবল, সুমন জানে বন্ধুদের মধ্যে। ওর ও যে একটা হৃদয় আছে এবং অন্য অনেকের থেকে সেটা নরম, কাউকে বুঝতে দেয়না । নীরবে কাজ করে যায় তাই পার্থর চোখের কোন চকচক করেছে দেখে ছেত্রী অবাক, পার্থ স্যার ওর থেকে বয়সে ছোট দু চার বছরের, কিন্তু ছেত্রী ওকে ভাইয়ের মতো ভালোবসে আর তাই পুজোর ছুটিতে দুই পরিবার একসাথে ঘুরতে আসে ।
দ্রুত ছেত্রী ফাদার রোমারিও কে ফোন করে বলে, স্যার এক্সাম ডেট চেঞ্জ করতে হবে আর পার্থ স্যার আরো একসপ্তাহ পরে আসবেন , ইট’স এন ইমার্জেন্সি । সংক্ষেপে ফাদার কে ঘটনাটা বলেন ছেত্রী, পার্থ বাধা দিতে গিয়েও দেয় না, সে মুখচোরা ছেত্রীর এই আগবাড়িয়ে তার ছুটি চাওয়া অন্য সময় বেশ রাগ হতো, আজ ভালো লাগলো ।
ছেত্রীদা বললো , ফাদার বললেন, কোনো চিন্তা নেই, ফিজিক্স একেবারে শেষে নাও, দরকার হলে আফটার এ গ্যাপ অফ ফিউ ডে’জ ।
যাক একটা বোঝা নেমে গেলো আপাতত পার্থর। ছাত্রদের কোনো অবহেলা ও মানতে পারেনা।
ছেত্রীদা বললো “আপনার ওই সুমন বাবুর ডিটেলস দিন, একটু বুঝি ওকে,”।
পার্থ বলেছিলো হেসে রাত কাবার হয়ে যাবে । তবু শুনুন ।
সুমনের সাথে ও ক্লাস সেভেন থেকে একসাথে ফিজিক্স অনার্স পর্যন্ত পড়েছে । ছেলেটা চিরকালের পাগলা, ক্লাস এইটে জ্ঞানের আলো বলে একটা যন্ত্র বানালো, যেটা সঠিক উত্তর দিলে গ্রীন লাইট আর ভুল হলে লাল এলইডি জ্বালাতো । পুরো ইস্কুল অবাক । তারপর বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলো একদিন, খোঁজ করে পাওয়া গেলো পলাশীর মাঠ আর হাজারদুয়ারী দেখতে গেছেন বাবু । স্কুল আর বাড়িতে গণধোলায়ের পর বললো, সিরাজ কে চেনা দরকার ছিল । বুঝুন কেমন বোহেমিয়ান !
পার্থ বরাবরের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সেকেন্ড বয় শিক্ষকদের চোখের মনি। আর সুমন কখনো বাঁধা ছকে চলেনা, ইতিহাসের ক্লাসে ভূগোল পড়তো ,অথবা বিজ্ঞানের ক্লাসে অঙ্ক। সহজে পড়া মুখস্তের ধার দিয়ে যেতনা, কতবার পার্থ বলেছে অরে সামনে টেস্ট, এবার বইয়ের পড়া কর । হেসে বলেছে ধুর জানার আবার সিলেবাস কি? জানতে ইচ্ছে হলে পড়বো, না হলে নয় ।
ভালো ক্রিকেট খেলতো। বড়লোক বাড়ির ছেলে। ওর দাদু স্কুল বিল্ডিং তৈরিতে একজন উদারহস্ত দাতা ছিলেন, মতিঝিল কলেজ ও তাঁর সাহায্যে তৈরী কিন্তু কোনো দিন তা জহির করতো না। স্কুলে আর পাঁচটা সাধারণের মতো ঘুরতো । ইস্টবেঙ্গলে জুনিয়র দলে সিলেক্ট হলো, চান্স না পেয়ে ফিরে এলো, পরে জানা গেলো, এক গরিব ক্রিকেটার গ্রামের ছেলে এসেছিলো, বাবু তার ব্যাট প্যাড গ্লাভস দান করে চলে এসেছেন, আর মাঠ মুখো হয়নি, কোনো দিন।
শুধু ওই বিশাল তিনতলা বাড়ি আর ওই পাড়াতেই নয় দশটা তিনতলা বাড়ি ছিল, ভাড়া দেয়া। সাম্যবাদী পরিবারের ছেলে পার্থ, কিন্তু স্বভাবিক শ্রেণী শত্রু ওর বন্ধু হয়ে গেলো। ওদের বাড়িতে বহুবার যাওয়া আসা ওদের সকলের, সুমনের মা ওর বন্ধুদের নিজের ছেলের মতোই দেখতো । সেই সময় বাড়িতে কালার টিভি, ফ্রীজ, টেলিফোন মায় আস্ত একটা বিলাতি অস্টিন গাড়ি বুর্জোয়া পরিবারের পুরো লক্ষণ, কিন্তু মজার ব্যাপার এই অহংকার কোনোদিন দেখায়নি, কেউই ।
সুমনের দাদু বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, বিধান রায়ের বিশেষ বন্ধু আর ঠাকুর্দা ছিলেন নেতাজী সুভাষের বন্ধু সশস্ত্র বিপ্লবী, পাবনার বিশাল সম্পত্তির অংশ, এক কথায় আজাদ হিন্দ ফান্ডে দিয়ে দিলেন । নেতাজির সাথে মান্দালয়ের জেলে ছিলেন একসাথে। তাই বুর্জোয়া তাদের বলা যেতো না কোনো ভাবে, উল্টে ওর বাপ্ ঠাকুর্দার দানের ফিরিস্তি এখনো এলাকার লোকে বলে ।
এই রকম পরিবারের ছেলে, কোথায় নিজেরটা বুঝে নেবে তা না, রাস্তার লোক ডেকে বাড়িতে খাওয়াতো, ওদের কাজের লোক হিন্দুস্থানী রতন দা
জিজ্ঞেস করতো “এ কৌন হ্যায়” উত্তর “মেরে দোস্ত কা চাচা” ” চাচা ফাটা জামা পরে ঢুকতো, আর ঘরের কারো জামা পড়ে বের হতো ।
একবার ওদের বন্ধু অভিজিৎ ডাকনাম যার “গামছা” কেউ কেউ “স্ট্যালোন”ও বলতো, বর্তমানে কেন্দ্রীয় এক ফ্যাশন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র প্রফেসর নামের আগে ডক্টর। তবে মলমের নয়, কলমের, মানে আইআইটি মুম্বাই থেকে পিএইচডি । বলেছিলো সুমন, ওটা আস্ত উন্মাদ “একবার ওদের বাড়ির পিছনের বাগানে পাম্প খারাপ হলো , এই সময় বাগানের ভিতর থেকে কাল কেউটে না গোখড়ো বেরোলো বড় সাইজের দুই পিস্, সবাই মারতে গেলে ও বাধা দিয়ে বললো, প্রকৃতির জিনিস ওদের ছেড়ে দাও । তাই বলে ওকে বৈষ্ণব ভাবার কোনো কারণ নেই, কাঁচের গ্লাস এ জোনাকি ধরে তাদের ব্রাউনিও মোশনে মুভমেন্ট হয় কিনা, পিঁপড়ে কে বাধা দিলে, সে ফিবোনাচ্চি সিরিজে চলে কিনা, এই সব দেখতো| এডিশনাল ফিজিক্স পরীক্ষার আগে, বুদ্ধদেব গুহর লেখা “কোয়েলের কাছে” পড়ে ছিল সারা রাত ধরে। এমনই উন্মাদ সারাজীবন। ও নিজে কে ঋজু বোস বলে ভাবতে, ভালোবাসতো । জঙ্গল ছিল খুব প্রিয় । কিছুদিন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করলো, এমনকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর ক্যানন থেকে জুরি অ্যাওয়ার্ডও পেলো পরে। যাক সে কথা।
সবাই খুব চিন্তিত ছিল, পাগল পরীক্ষা দেবেতো, মাধ্যমিকে সে সময় সোনার টুকরো না হলে, ষ্টার পেতোনা, খাঁটি ২৪ ক্যারেট হলে তবেই ষ্টার পেতো । আশা মতো, নীলাভ্র, পার্থ, শুভেন্দু শুধু ষ্টার নয় সাথে গোটা ছয়েক করে লেটার পেলো, সবাইকে চমকে দিয়ে পাগল পেলো ৬৬৬! নয় সাবজেক্টে ১ নম্বর করে আর পেলে ষ্টার ওর হয়ে যেত, তিনটে লেটার ও পেলো ফিজিক্স, বায়োলজি আর ভূগোলে । হেসে বললো, তোরা হলি ২৪ ক্যারেট গোল্ড, আমি নয় ২২ ক্যারেট থাকলাম, জরোয়ার মালা হয়ে, সবার গলায় ঝুলবো।
সে বছর ন্যাশনাল স্কলারশিপ ৬৫০ পেলেই দিতো সরকার, অবলীলায় পেত, এপ্লিকেশন করলে, করলো না, বললো অনেক ছেলে মেয়ে আছে, তাঁরা পেলে লেখা পড়া চালাতে পারবে, আমারটা দাদুই পারবে।
“ও পার্থদা এতো সিধা সোচ্কা উল্টা খোপড়ী আদমি” এই পর্যন্ত শুনেই ছেত্রী বললো । কোথায় থাকতেন আপনার দোস্ত কলকাতায়? কেমন চেনা চেনা লাগছে ঘটনা গুলো । সুমনদের টাইটেল কি ছিলো? সান্যাল কি?
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানলেন, আমি তো বলি নি ।
এবার ছেত্রীদার চোখে জল।
আরে ওর দাদুই তো আমাকে লিখা পড়া করিয়েছেন, ওদের কাছেই আমার বাপ্ ঠাকুরদা দারোয়ান ছিল । আই নো হিম । এখন আমার কাজ ওকে খোঁজা, ছবি আছে লেটেস্ট?
পার্থ বললো আমার কাছে নেই, বিল্টুর কাছে আছে, চেয়েছি পাঠাচ্ছে ।
পার্থ বললো “ছেত্রীদা চলুন, আগে হোটেল বুক দিতে হবে আর বিল্টুকে একটা ফোন করতে হবে, পম আসছে ওর বাড়িতে, অনলাইন মিটিং করবো আমরা ।”
হ্যাঁ চলুন ।
ছাত্রীদার বোলেরোতে উঠে বসলো পার্থ। মনে মনে ভাবছে রিনচেন লামা কি সত্যি সুমন, না অন্য্ কেউ ।
এমন সময় বিল্টুর হোয়াটস্যাপ কল এলো, ভিডিও কল, অনেক বছর পর আবার স্ক্রিনের সামনে দুই বন্ধুর দেখা, চুলে পাক ধরেছে বিল্টুর, আরো হ্যান্ডসাম হয়েছে। আমেরিকার জলহাওয়ায় । বার বার সিগন্যাল কাটছে ।
“বিল্টু আমি হোটেলে গিয়ে কল করছি” বললো পার্থ ।
“সিগন্যাল খারাপ আছে একটু পরে হোটেলে গিয়ে কল করছে “। গ্লাস তুলে নিতে নিতে বললো বিল্টু , সামনে গোল হয়ে অংশুমান, শতরূপা আর বিপ্লবদা মানে ড. বিপ্লব চৌধুরী, বিল্টুর টেক্সসাসের প্রতিবেশী এবং ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। নাম করা সাইকোলজির অধ্যাপক হুস্টনের য়ুনিভার্সিটিটির ।
শতরূপা উঠে গেলো “শোলে কাবাব” ম্যারিনেট হলো কিনা দেখতে ।
বেশ একটা সাসপেন্স থ্রিলার হয়ে উঠেছে লোকটা, না থেকেও জড়িয়ে থাকছে আষ্টেপিষ্টে।
আইডেন্টি কার্ডের রক্তের দাগ পরীক্ষায় ওর মেয়েদের সাথে ডিএনএ ম্যাচ করেছিল, সেই রক্তের। তাই পুলিশ মৃত বলেই ধরেছিলো, তিস্তার ওই অঞ্চলে লেওপার্ড আছে অনেক। তাই কেউ সন্দেহ করেনি আর ।
কিন্তু পার্থদা খুবই বিচক্ষণ মানুষ, হিসেবে করে কথা বলেন, বাজে কথা বলার লোক, সে নয় । তারপর ক্লাস সেভেন থেকে একসাথে রোজ যাকে দেখেছে, তাঁর কি ভুল হবে ছোটবেলার বন্ধু কে চিনতে?
“এই এদিকে এস পার্থ কল করছে ” । বিল্টু ডাক দিলো শতরূপাকে ।
*** কাল্পনিক গল্প বাস্তবের চরিত্র ***