নব-পত্রিকা
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী
বাংলাতে শারদীয়া দুর্গাপূজা’র কল্পারম্ভ দেবি-পক্ষের ষষ্ঠী তে । সন্ধ্যাবেলা বোধন। এর পরে অধিবাস। ‘কল্পারম্ভ’ মানে..দেবি-পুজোর আনুষ্ঠানিক সূচনা। নির্দিষ্ট কোনো বেল-গাছের ডালে শ্রদ্ধা সহ সিঁদুর চিহ্নিত করে সেই বেল-গাছের নিচে পূর্ণ কলস রূপে দেবির অধিষ্ঠান। পবিত্র সেই কলসের চারদিকে চারটি তির মাটিতে পুঁতে পাঁচ বা সাত-পাক লাল সুতোর বেষ্টন ও পূজা-পাঠের পরে পুরোহিত মহাশয় করজোড়ে প্রার্থণা জানান……….” দেবি চণ্ডাত্মিকে চণ্ডি চণ্ড বিগ্রহকারিণি। বিল্বশাখাং সমাশ্রিত্য তিষ্ঠ দেবি যথাসুখম্।।”
বিঘ্ন-হারিণী হে মা! তুমি কৃপা করে আজ রাতটুকু র জন্যে এই বেলের ডালে আশ্রয় নিয়ে আনন্দে থাক। সপ্তমীর পবিত্র মুহূর্তে সেই বিল গাছের তলায় গিয়ে বিধিসম্মত আচমন, স্বস্তিবাচন ও মংগল সূচক ধান-দুর্বা তিল সহ আবারও পুজো-পাঠ। শেষে, আগের দিনে সিঁদুর চিহ্নিত জোড়া বেল সহ ডালটিকে ছেদন করার পূর্বে পুরোহিত আবারও বিল্ব-বৃক্ষের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করবেন………..” ওঁ বিল্ববৃক্ষ মহাভাগ সদা ত্বং শঙ্করপ্রিয়ঃ। গৃহীত্বা তব শাখাঞ্চ দুর্গাপুজাং করোম্যহম্।। শাখাচ্ছেদোদ্ভবং দুঃখং ন চ কার ত্বয়া প্রভো।”……. হে পবিত্র বিল্ববৃক্ষ ! আমি জানি, আপনাতে দুর্গা-পতি, শিব- ঠাকুরের এর বাস। তবু, আজ আমি আপনার ডাল ছেদন করছি সেই দেবি দুর্গার ই পুজোর উদ্দেশ্যে। ছেদন-জনিত এই কষ্ট দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।(লক্ষনীয়, নির্বিচারে বন উচ্ছেদ বা চোরা-কাঠ পাচারের এই যুগে বাস করে একটা সামান্য বেলের ডাল কাটার আগেও এই প্রার্থনা……… ভাবা যায়!)
এরপরে, জোড়া-বেল সহ সেই সিঁদুর-আরক্ত ডাল ও “নব-পত্রিকা” সহ পুরোহিত এবং তন্ত্র-ধারক মন্ডপে প্রবেশ করলেই পুজার মূল-পর্ব শুরু হয়।
পুরোহিত মশাই’র উদাত্ত কন্ঠে শোনা যায়” ……বোধনের মন্ত্র:
.
রাবনস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ ।
অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যাস্তয়ি কৃতঃ পুরা ।।
অহমপ্যাশ্বিনে তদ্ববোধয়ামি সুরেশ্বরীম্।
শক্রেনাশি চ সংবোধ্য প্রাপ্তং রাজ্যং সুরালয়ে।।
তস্মাদহং ত্বাং প্রতিবোধয়ামি বিভূতি রাজ্য প্রতিপত্তি হেতোঃ।।
যথৈব রামেন হতো দশাস্যস্তথৈব শক্রন্ বিনিপাতয়ামি।।
তস্মাৎ তিষ্ঠ মহাভাগে যাবৎ পূজাং করোম্যহম্।।
মূলে সমাগতে শুক্লসপ্তম্যামাগমিষ্যসি।।
দেবি চন্ডাত্মিকে চন্ডি চন্ডবিগ্রহকারিনি।
বিল্বশাখাং সমাশ্রিতা তিষ্ঠ দেবি যথাসুখম্।।
“রম্ভা-কচ্চী হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ “নবপত্রিকা”। কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম,অশোক, মান এবং ধান এই ন’টি আস্ত গাছ বা পাতাকে বড় একটি কলা পাতায় মুড়ে তার বুকের কাছে বেল দুটিকে রেখে সুন্দর এক লাল-পেড়ে সাদা শাড়িতে সাজানো হয়। তার ওপরে জড়ানো থাকে সাদা অপরাজিতা ফুলের লতা। সিঁদুর- চর্চিত এই দিব্য-বস্তুটিকে রাখা হয় দেবি’র ডানদিকে। গনেশ এর ঠিক পাশে। কেউ কেউ একে “কলা-বৌ” বলেন। কেউ ভাবেন গনেশ এর পত্নী। বিষয়টি কিন্তু আদৌ তা নয়।
সবেতেই ঈশ্বরত্ব আরোপ করার এ এক অপূর্ব শৈলী। বৈদিক পরম্পরায় কোনো কিছুই যে অপাঙক্তেয় নয়। সব কিছুই সেই পরমেশ্বর এর প্রকাশ….এই চেতনা। কলাতে যিনি ‘ব্রহ্মাণী-রূপা’, কচুতে তিনি ‘কালিকা’। হলুদের ডালে যিনি ‘ঊমা’ জয়ন্তীর শাখাতে তিনিই ‘কার্তিকী’। বেল এর ডালে ‘শিবা’ যিনি, ডালিম এর ডগাতে ‘রক্তদন্তিকা’ ও তিনি। অশোক এ ‘শোক-রহিতা’, মানকচুতে সাক্ষাৎ ‘চামুণ্ডা-স্বরূপা’। আবার ধান এর গুচ্ছে ‘মহালক্ষ্মী’ ভাবে সেই একই মা।
আজকের শিক্ষিত সমাজ নব-পত্রিকার এই পুজোর আড়ালে আসলে, খাদ্য ও শষ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদ-কূল কেই মর্যাদা দেওয়ার এক সামগ্রিক উদ্যোগ মনে করেন। অন্য আর একদল বিদ্বজ্জন ভাবেন নব-পত্রিকার পুজোর মধ্য দিয়ে নয়টি বনৌষধি কে দেবির পাশে রেখে আসলে, আয়ূর্বেদ এর প্রতি সম্মান জানানো হয়ে আসছে সেই আবহমান কাল থেকে। দু’টো যুক্তিই ঠিক হতে পারে। কিন্তু আসল সত্যটা হয়তো বা আরও গভীরে।
বেদ এর ঋষি স্পষ্টরূপে স্রষ্ঠার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেনঃ
” ওঁ দ্যৌ শান্তিঃ অন্তরিক্ষং শান্তিঃ পৃথিবী শান্তিরাপঃ শান্তিরোষধয়ঃ শান্তিঃ। বনষ্পতয়ঃ শান্তির্বিশ্বেদেবাঃ শান্তির্ব্রহ্ম শান্তিঃ সর্বং শান্তি শান্তিরেব শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি।।”
শান্তি শব্দের অন্যতম অর্থ – বিঘ্নরহিত উদ্বেগশূন্য আনন্দময় জীবন। সনাতন বা হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, বিঘ্ন তিন প্রকার। যথা – আধ্যাত্মিক বিঘ্ন: শারীরিক ব্যাধি, মানসিক অস্থিরতা, অঙ্গহানি ইত্যাদি। আধিভৌতিক বিঘ্ন: সাপে কামড়ানো, বাঘে ধরা ইত্যাদি। আধিদৈবিক বিঘ্ন: প্লাবন, মহামারী, খরা ইত্যাদি।এই তিনরকম বিঘ্ন নাশ করতে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকর্মাদিতে শান্তিমন্ত্র পাঠ করা হয় এবং শেষে তিনবার ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ ,ওঁ শান্তিঃ বলা হয়।
সনাতন ধর্মের শক্তি বলতে একটাই….. দেব-দেবিরূপী শ্রী ভগবানের কাছে প্রার্থনা…..শুধুই প্রার্থনা, কেবলই মঙ্গল- কামনা । আর, অবশ্যই তা কেবল নিজের বা নিজের পরিবারের জন্য নয়।
প্রার্থনা পৌঁছে যেতো ভূ-লোক ছাড়িয়ে দ্যুলোকে, দ্যুলোক থেকে অন্তরিক্ষের বায়ু- বজ্র-বিদ্যুৎ-সূর্যদেব এর জন্য…..তা ঝাড়গ্রাম এর “কনক-দুর্গা”র কাছে বলুন বা জলপাইগুড়ির “বন-দুর্গা”র শ্রী চরনে।
Author : Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown light on many fronts.