নন্দিতার নীল আসমান

0
770
Faruque Ahamed
Faruque Ahamed
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:41 Minute, 6 Second

নন্দিতার নীল আসমান

ফারুক আহমেদ

১.
স্বপ্নের মতো প্রেম সে পরির মতো রাজকন্যা। স্বপ্নের কথা বলতে নেই। সব স্বপ্ন সত্যি হয় না। ভালবাসার মানুষ হওয়ার দৌড়ে সামিল করেছে নিজেকে নীল আসমান।
সুললিত সুর ভেসে আসছে কোন অজানা উদ্যান থেকে, যার মোহিনী-জালে ক্রমশ আরও অতলে ডুবে যাচ্ছে নীল। কেউ বুঝি মাথার এলোচুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে গভীর আবেগে। কানের কাছে বেজে চলেছে অনুরণনের পরিচিত তাল লয় আর ছন্দ, “আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই…।” ঘুম ঘুম চোখে নীল যেন দেখতে পায়, সুরের ঝর্ণায় ভিজতে ভিজতে রুমঝুম পায়ে নেমে আসছে নন্দিতা তার ভালোবাসার আকাশ থেকে…। চমকে ওঠে নীল। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসতে বসতে দেখে, শ্বেত-শুভ্র বালিশের পাশে নবজাতকের মত একটানা আর্তনাদ করে চলেছে মুঠোফোনটা, শূন্য বিছানার একপাশে ভাঙা বাঁশির মত পড়ে আছে এলোমেলো পাশ বালিশ। অদ্ভুত একটা বিষণ্ণ আলোয় ভারি হয়ে আছে ঘরের বাতাস। নীল বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “নন্দিতা, তুমি কোথায়! তুমিই আমার তানিয়া পরির মতো রাজকন্যা”।

২.
ঘুমের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে নন্দিতাও স্বপ্নে বিভোর। তার দুচোখের পাতায় ঘুরে বেড়ায় কলেজ-প্রেম নীল আসমানের কচি নরম তেতুল পাতার মত উস্কোখুস্কো এলোমেলো চুল! আপন মনে কত কথা বলে নন্দিতা। ফাল্গুনী হাওয়ায় ফুরফুর-করে-উড়ে-যাওয়া চুলের মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে চায় নীল আসমানের নরম শরীর। হঠাৎই ধড়মড় করে উঠে বসে নন্দিতা। শূন্য বিছানায় খাঁ খাঁ অন্ধকার হিংস্র চিতাবাঘের মত নন্দিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কোথায় নীল! নন্দিতা ভাবে। রাতের আকাশে অগুনতি তারার আলোয় জেগে থাকে নিশাচর পাখি। একরাশ কালো অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে নন্দিতার নিজেকেও এক বিশাল প্রাগৈতিহাসিক নিশাচর বলে মনে হয়। নিজেকে বড় অপরাধী লাগে নন্দিতার। ভালোবেসেছিল মুসলিম পরিবারের সন্তান নীল আসমানকে। কিন্তু মা-বাবার ঠুনকো জাত্যাভিমান আর সংকীর্ণ একগুঁয়েমির কারণে নীলকে আপন করে নিতে পারে নি। বারবার নিজের মনের চাওয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে একাকীত্বকেই বরণ করে নিয়েছে, নীল আসমানের জীবনসঙ্গী-হওয়া থেকে সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে। অথচ নীলের তো কোন অপরাধ ছিল না! নন্দিতা মনে মনে বলে আমরা তো সবাই আদি পিতা মাতার সন্তান। তাহলে এতো জাত বিচার, বিদ্বেষ প্রকাশ কেন মানুষের মনে।

৩.
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হওয়ার পর নীলের হাতে অফুরন্ত সময়। রেজাল্ট বের হলে কলেজ প্রাঙ্গণে জ্বলজ্বল করবে নীলের নাম! সে ভাবে। সে চায় মানুষের মত মানুষ হতে। মনের পরতে পরতে শুধুই সমাজ কল্যাণের চিন্তা ঘুরপাক খায়। রাস্তায় পড়ে-থাকা বিপদ সরিয়ে রাখে সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ইটের টুকরো, কলার খোসা বা ভাঙা কাচের টুকরো, ডাবের খোলা দেখলেই সে তুলে নিয়ে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। সময় পেলেই নজরুল-সুকান্ত পাঠাগারে গিয়ে লাইব্রেরিয়ান রফিকুল ইসলাম কাকুর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।ঘটকপুকুর হাই স্কুলে পড়তে পড়তেই লাইব্রেরিয়ান কাকুকে সে আপন করে নেয়। লাইব্রেরিয়ান কাকু যেন জ্ঞানের এক মহাসমুদ্র! মনে করে নীল।

মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল নীল আসমান। ভালো রেজাল্ট-করা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে স্কলারশিপের ফরম জোগাড় করে সেই ফরম পূরণ করে সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দিয়ে এসেছিল। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা তার সাহায্যে স্কলারশিপ পেয়ে যায়। গরীব ছাত্র স্বপন বিশ্বাস আর নাজিম আহমেদের জন্যে বইও কিনে দিয়েছিল টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে। সেই থেকে সে এলাকার মানুষের জন্যে মুশকিল আসান হয়ে উঠছিল। পরবর্তী সময়ে সকলের জন্য সব প্রয়োজনের বন্ধু হয়ে উঠেছিল নীল আসমান।

বেশ চলছিল স্কুল ও খেলাধুলা। একবার নীল বাড়ির বিনা অনুমতিতেই সহপাঠী কুতুবউদ্দিন গাজীর সঙ্গে চৈতালি প্রেক্ষাগৃহে শাহরুখ খানের “ডর” সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। ‘জাদু তেরি নজর…’ গানটা মনে বেশ দাগ কেটেছিল। শাহরুখ খানের জবরদস্ত ফ্যান হয়ে উঠেছিল নীল। ঘটকপুকুর আর ভাঙড় হাইস্কুলের অনেকেই জানত নীল শাহরুখ খানের খুব বড় ভক্ত। এই নিয়ে মজাও হত খুব। খেলার মাঠে, স্কুলে, কলেজে অনেকেই ‘কোয়েলা’ সিনেমা হিট না ফ্লপ এই নিয়ে খেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করত নীলকে। হাইস্কুলে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়বার সময় বায়োলজি ও ভূগোল ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবীরা শাহরুখ খানের সিনেমার কথা, গানের কথা আলোচনা করতে করতে নীলকে নাচ দেখানোর জন্যে জোর করত। একবার আবুল হোসেন বিশ্বাস স্যারের উদ্যোগে ভাঙড় মহাবিদ্যালয়ের মাঠে পিকনিককে স্মরণীয় করে রাখতে “বাদশা” সিনেমার একটা গানের সঙ্গে তুমুল নেচে নীল সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। নন্দিতারও খুব ভাল লেগেছিল নীল আসমানের নাচ। শিশুর মত খলবল করে হাসতে হাসতে হাততালির সাথে নেচে উঠেছিল নন্দিতাও! গানটি ছিল ‘ও লেড়কি যো সবসে আলাগ হে…’। সেদিন ‘তুম ভি সবসে আলাগ হো’ — মনে মনে নীল আসমান বলেছিল।

নন্দিতা! নন্দিতা মন্ডল!!

আম বাগানের ফাঁক দিয়ে সবুজ আলোয়-মাখা নীলচে মেঘের মত দীঘল দুটি অপরূপা চোখ! মুগ্ধ বিবশ চোখে নীল আসমান দেখেছিল, পরীর মত এক রাজকন্যা ঠায় দাঁড়িয়ে, স্থির, নির্বাক। আকাশের দিকে মেঘের মত দুই চোখ মেলে দিয়ে যেন খুঁজে ফিরছে শিমুল পলাশের মাঝে ভালোবাসার রঙ! সেই নন্দিতা — এক আকাশ ভালোবাসার এক তুমুল শিহরণ! নন্দিতা নেই। কিন্তু চৈতালি সিনেমা হলের সামনে সেই আমবাগানের দিকে তাকালেই নীল দেখতে পায় নন্দিতাকে……চিকন সুতোর কাজ-করা সাদা সিফনের ঘাগরায় সেজে-উঠে নন্দিতা গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে গাইছে, ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি…..!’ নীল বিহ্বল হয়ে যায়।

৪.
বন্ধুদের মধ্যে সানি ছিলো নীলের খুব প্রিয়। শাহরুখ খানকে নিয়ে সানির সঙ্গে আলোচনাও চলতো বেশ মজা করে। সানি কলকাতার নামি স্কুলে পড়ে, কলকাতাতেই থাকে। বড় ছুটি পেলেই সে মা-বোনের সঙ্গে ঘটকপুকুরের বাড়িতে চলে আসে। তখন নীলের সঙ্গে সানির দেখা হয়। খেলার মাঠে, আরও অন্য কোথাও। তখন কত গল্প করে দুজনে। শাহরুখ খানের নতুন ছবি কেমন হয়েছে, ভালো অভিনয় করার জন্য কী পুরস্কার পেয়েছে, কোন ছবি সব থেকে বেশি হিট হয়েছে–এইসব নানা কথা।

একবার সানিদের বাড়ির ছাদে চড়ুইভাতির কথা আজও ভুলতে পারেনি নীল। “দিল তো পাগল হ্যায়” সিনেমার গান শুনতে শুনতে ভেসে আসে মনের আকাশে আম বাগানের সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা সেই চোখ– চোখের গভীরে যার ফাল্গুনী হাওয়ায় টলমল করে ভোরের শিশির! আজও মনে পড়ে সেই গান, ‘চাঁদনী কুছ কাহাঁ রাতনে কুছ শুনা….’। নিজের মনেই বিড়বিড় করে নীল…তোমার বিনুনি-করা চুলের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে অফুরন্ত প্রেম আমাকে হাতছানি দেয়… আমার ভালোবাসার মেঘ জমে ওঠে সারা আকাশ জুড়ে…ওই চোখের ইশারায় আমি প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরি আমার প্রেম…তোমার মুখোমুখি হতে পারলে ধন্য হত এ জীবন… আমি তোমার হৃদয়ের আকাশ-প্রেমিক হতে চাই নন্দিতা।

৫.
নীল তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে সে সব খেলায় শেষের দিক থেকে প্রথম হয়। ঘটকপুকুর হাইস্কুল ও ঘটকপুকুর রিফিউজি গার্লস স্কুল পাশাপাশি হওয়ায় খেলার মাঠ একটাই। নীল দৌড়ে সবার পিছনে পড়ে যায়, এতে অনেকেই হাসাহাসি করে। দৌড়ে সবার পিছনে পড়ে যাওয়ার জন্য সে লজ্জাও পায়। নন্দিতাও নীল আসমানের দৌড় দেখে হাসাহাসি করে বন্ধুদের সঙ্গে।

নীল আসমান শাহরুখ খানের এতো বড় ফ্যান। আর সে সবার সামনে হেরে যাবে তা হতে পারে না। তাকে পরের বছর জিততেই হবে। এই জেদ চেপেছিল।

বাড়ি ফিরে সে মাকে সব বললো। তার মায়ের পরামর্শ মতো নিয়মিত সারা বছর দৌড় অনুশীলন করলো। কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা ও কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিজেকে তৈরি করলো। পরের বছর নীল দৌড়ে প্রথম হলো। আবৃত্তি, বক্তৃতা ও কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রাইজও পেল। মনে মনে ঠিক করল সে চেষ্টা করলে পড়াশোনাতেও ভালো করতে পারবে। ভালো রেজাল্ট তাকে করতেই হবে। পরবর্তীতে নীল আসমান স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আন্তঃস্কুল আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে সে। জেলা স্তর এবং রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতাতেও নীল আসমান পুরস্কৃত হয়েছে কয়েকবার।

ক্লাস নাইনে উঠে সে শপথ নিল নিজের মনে, প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। তাদের স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়ে বোদরা হাইস্কুলে। সেবার তার দাদা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। নীল তা দেখতে একদিন বোদরা হাইস্কুলে উপস্থিত হলো। আম বাগানের ফাঁক-দিয়ে-দেখা সেই মায়াবী চোখের ভালোবাসার দৃষ্টি আবারও দেখতে পেল সেদিন। সেই মায়ায় ঘেরা চোখ — অতল গভীরে যার সাত সমুদ্দুরের ঢেউ!

নীল আসমান তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। একটা ভাঙা-চোরা সাইকেল। গায়ে ঘটকপুকুর চৌমাথার ফুটপাত-থেকে-কেনা সবুজ রঙের গোলগলা গেঞ্জি। স্কুল যাওয়ার জন্য একটিমাত্র প্যান্ট। তাতে ধুলো লেগে থাকে সবসময়। সেই প্যান্ট আর গেঞ্জি পরেই ছুটে এসেছিল বোদরা হাইস্কুল।

আম বাগানের ফাঁক দিয়ে দেখা সেই চোখ নন্দিতার। স্বপ্নের পরীর মতো অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা হয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে-থাকা নীল তা দেখে চমকে ওঠে। নীলের চোখ যখন তার চোখে পড়ল, তখন সে দেখল তার হাতে মোমবাতি, পিচবোর্ড, কলম রাখার জন্য পেন্সিল বাক্স। বাবরি কাট চুল আর ভুবন জয়ের হাসিতে সে যে কী যাদু, তা শুধু নীলই জানে।

এদিকে নীলের ভাঙা-টালির ছাউনি দিয়ে বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর। ভিজে যায় বিছানার চাদর। মা-বাবার আশা জাগায় নীল আসমান। সে নতুন আকাশ দেখার সাহস জোগায়।

অন্য দিকে ভালোবাসার জন্য কিছু করে দেখানোর জেদ। বই কলম খাতা নিয়ে সেই যে পড়তে বসা, আজও সে লিখছে, পড়ছে। প্রকৃত মানুষ হতে। নীল আসমান সমাজ কল্যাণে নানান উন্নয়ন মূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে তার জন্য সে ভাঙড় এলাকার নয়নের মণি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে মানুষের মনে। তার দুচোখ জুড়ে ভেসে বেড়ায় সেই দুটো চোখ অনন্ত এক নীল আকাশের মত! ইচ্ছে হয়, একদিন সে তার ভালোবাসার সামনা-সামনি হয়ে সব মনের কথা খুলে বলবে।

ভালোবাসার যোগ্য হতে সে তাই পড়াশোনায় গভীর মনোনিবেশ করে। স্কুল জীবনে দু’টো পরীক্ষাতেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। কলেজে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে যায় নন্দিতার সঙ্গে। প্রথম দিনের দেখা আস্তে আস্তে পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এগিয়ে চলে ঘনিষ্ঠতার দিকে। একদিন নীল আসমান নন্দিতা মণ্ডলকে মনের কথা সব গুছিয়ে বলে। নন্দিতাকে ভালোবাসার কথা জানায় নীল। ঘাসের শিশির মুখ তুলে তাকায় রোদ্দুরের উষ্ণতার দিকে।

সেদিন বাড়িতে ফিরে নীল লিখল তার জীবনের প্রথম চিঠি– ঠিক একটা কবিতার মতো :

নন্দিতা, তোমার তুলনায় এ জীবন কিছু না, কোথায় তুমি আর কোথায় আমার ভালবাসাহীন মায়াহীন এ ধূসর জীবন। চলার পথে ভালবাসা নেই, তুমি নেই, কিন্তু তুমি কি জানো, আমি তোমায় কতটা ভালবাসি? নিজের থেকেও বেশি!!!,

দেখেছ! আজ আকাশটা কত্ত নীল, আর জানো! আমি যখন তোমায় এ কথাগুলো লিখছি, এই অন্ধকার রাতটার তারাগুলো কত্ত সুন্দর আকাশ আলো করে জ্বলছে…. তারারা ডাকছে….চাঁদনি রাতের আকাশ জুড়ে ভেসে উঠছে তোমার ছবি। তোমার প্রতিচ্ছবি মনের আকাশ জুড়ে।

একটা কথা না বলে পারলাম না, আমি তোমার আদরে আদরে দুষ্টুমিতে লীন হতে চাই। এ জীবনে শেষ কবে চুমু খেয়েছি ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তা মনে নেই। আমার ভালবাসার স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে বাঁচতে চাই বাকি জীবন।

জানি আমি এন আর আই নই। আমি দেশি গ্রামের সাধারণ অতি সাধারণ একটা ছেলে। কিছু চাইনা আমি, নিরিবিলিতে নির্জনে সময় পেলে ভালবাসা আদর দিয়ে এ জীবন ধন্য করে দিও।

আমার স্কুল জীবনের প্রথম প্রেম ভালোলাগার স্বপ্নের পরী তুমি। তোমার জন্য এ বুকে ভালবাসা-আকাশ রাখা।

হ্যাঁ তুমি তুমিই আমার ভালবাসা…একরাশ বাঁচার আকাশ…..

৬.
কী করবে নন্দিতা মণ্ডল! সে যে নিরুপায়। হিন্দুত্বের গৌরবে তার মা-বাবা মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করতে চায়, প্রেম ভালোবাসা সম্প্রীতির হৃদয়ের কানাকড়িও মূল্য নেই তাদের কাছে। নন্দিতা কিছুতেই মানতে পারে না জাত-ধর্মের এই নিষ্ঠুর মানবতাহীন প্রগলভতাকে। তবুও মা বাবার গড়ে-দেওয়া এই বেড়া ভেঙে বেরোতেও পারে না। নীলকে ধরেই বাঁচতে চায় সে। অথচ নীলের আছে একটা অতীত, একটা বর্তমান — যা সমাজ ও ধর্মের শিকলে বাঁধা। নন্দিতা কিছুই পরোয়া করে না। সব বিধি-বন্ধন ভেঙে এক ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, নীলের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে ইচ্ছে করে, নীল, এই ঘৃণার পৃথিবী ছেড়ে এই অসহিষ্ণুতার পৃথিবী ছেড়ে আমরা অন্য এক নতুন পৃথিবী গড়ে তুলি যেখানে মানুষ শুধু মানুষের পরিচয়ে বেঁচে থাকে, ধর্মের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে বেঁচে থাকে শুধু মানুষে মানুষে ভালোবাসা, প্রেম প্রীতির এক স্বর্গীয় সৌরভ। পারে না, কোথায় যেন একটা খটকা লাগে। এক বিশাল শূন্যতার কারাগারে একটু একটু করে ডুবে যায় নন্দিতা মন্ডল!

৭.
কলেজ জীবন শেষ করে ভালোবাসার নন্দিতাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য ‌নীল আসমান একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সেক্রেটারি পদে কাজ জোগাড় করেছে। নন্দিতার পরমর্শ মতো কাজে যোগ দিয়েছে। সে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার দৌড়ে ছুটে চলেছে প্রতিনিয়ত। শিক্ষামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে নীল রাত দিন সোসাইটির কাজে আত্মনিয়োগ করে।

জীবনে চলার পথে জুটেছে কত তাচ্ছিল্যের শেল, কত যন্ত্রণা, তা কেউ বোঝে না। অবজ্ঞার পাহাড় মাথায় নিয়ে পবিত্র ভালোবাসার অপেক্ষায় প্রহর গুনে গুনে রাত কাটে দিন কাটে নীল আসমানের।

অবচেতন মনে বলে চলে নীল— ফিরে এসো নন্দিতা। প্রেসিডেন্সি কলেজের দিনগুলো মনে পড়ে ফেলে-আসা সেই সব দিনের কথা। নন্দিতা মণ্ডলের অফুরন্ত শুভকামনায় প্রথম চাকরি পাওয়া। তবুও নন্দিতাকে না-পাওয়ার সকাল আসে। সূর্য ওঠে। খাদহীন প্রেম টলমল করে নীল আসমানের বুকে। সাংকেতিক প্রেম বিনিময়ের জায়গার নামগুলো এসপি, বনবিতান, কিডোম, স্মৃতি চিহ্ন, মনে পড়ে শপথ নেওয়ার কথা। শপথ রক্ষা করতে-না-পারার যন্ত্রণায় ছটফট করে দুজনেই।

নীল আসমান স্বপ্নের মধ্যে বিড় বিড় করে কত কথা বলে— এই নাও তোমার জন্য উদার বিস্তীর্ণ খোলা আকাশ। ভাবনার আসমান জুড়ে ভেসে ওঠে এ কার ছবি? কোন ছবি? বেলা অবেলায় এ কোন আত্মশুদ্ধি?

নীলের লেখা না-পাঠানো-খামে ভালোবাসার চিঠি। কত সুপ্ত প্রতিভার স্ফূরণ দেখি তোমার অণুপ্রেরণায়। মনে পড়ে ফেলে-আসা-দিনের সেই সব ভালোবাসার মুহূর্তগুলোকে। মুষ্টিবদ্ধ হাতে জেগে ওঠার আহ্বান। ভালোবাসা প্রেমের গান। আইএসএসএন নম্বরের জন্য উৎসাহ দিলে। আবেদন মঞ্জুর ২৩২০-৩৪৯৮।….. এক সঙ্গে উদার আকাশের নিচে হাতে হাত রেখে পথ চলা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কত জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ— সেই সব স্মৃতি আজও খুঁজে ফিরি। কলেজ ব্যাগে নিজের হাতে বসানো গাছের সবজি, পাতিলেবু, আম, জামরুল, সবেদা কত কী নিয়ে আসতে মনে পড়ে নন্দিতা? কখনো কিছু খেলেই মনে পড়ে তোমার মুখ। যদি কাছে থাকতে, কলেজ জীবনের মতো টিফিন খাওয়ার মতো দুজনে শেয়ার করে খেতাম।

নীল আসমান চাকরি করতে করতে দূরশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান নিয়ে এমএ পাশ করে। নিষ্ঠার সঙ্গে এডুকেশান সোসাইটির সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার কাজে মন দেয়। নীলের উদ্যোগেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফুলে ফেঁপে ওঠে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের স্কুল ও কলেজ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। নতুন বিএড এবং এমএড কলেজের অনুমোদন আসে তার হাত দিয়েই। সে সব অতীত ইতিহাস। একটা গ্রামকে শিক্ষানগর করে গড়ে তুলতে নীল আসমানের ভূমিকা ছিল অনেক। আজও বসন্তপুর গ্রামের মানুষের ভালবাসা নীল আসমান ভুলতে পারে না। সেই গ্রামের সব থেকে ভালো মানুষ ছিলেন ইসারুদ্দিন ফকির নামে এক নেক বান্দা, তাঁকে সবাই আজও ভালোবাসেন। তাঁর কবরস্থান মসজিদের পাশেই ছিলো অনাদরে। নীল আসমান সেটা নিজেই খরচ করে উদ্যোগ নিয়ে চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে এবং একটা নামের ফলক লাগিয়ে দিয়েছে। সেটা এখন একটা মাজারে পরিণত হয়েছে। সেখানকার ফলকে লেখার সময় নীল আসমান লিখেয়েছিলেন “ইসারুদ্দিন সাহেব ভালো মানুষ ছিলেন, আজও সবাই তাঁকে ভালবাসেন”…। দু বছর তিন বছর পর নীল আসমান সেই কবরস্থানের পাঁচিলটি রঙ করিয়ে দেয় নিজের উদ্যোগে। প্রতি শুক্রবার, সবেবরাতের দিনে এবং ঈদের নামাজ আদায় করা হলে গ্রামের প্রায় সমস্ত মানুষ ইসারুদ্দিন সাহেবের কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করেন এবং পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে মার্জনা চেয়ে নিয়ে দোয়া চান দেশবাসীর কল্যাণে এবং নিজ পরিবারের সদস্যদের জন্য, নিজের জন্য।

কচি কলাপাতার মতো নরম হাতে হাত, চোখে চোখ রেখে আবারও নীলের অগ্নিশপথ। নতুন করে বাঁচার লড়াই। এবার নীল তাঁর প্রিয় নায়ক শাহরুখ খানের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে ভর্তি হয়েছে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বছরে নীল আসমান তাঁর মেধার প্রমাণ দিয়ে নেট ও সেট দুটো পরীক্ষায় সফল হয়েছে। ভাঙড় হাইস্কুলের বায়োলজির আদর্শ শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন হালদার, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মাসাদুর রহমান আর ঘটকপুকুর হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক মুক্তময় মণ্ডল, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক সেলিম আহমেদ নীল আসমানকে সবসময়ই উৎসাহিত করতেন। মানুষের ভালবাসা অর্জন করতে হলে মাটির মানুষের সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে পিতা-মাতার উৎসাহ পেয়ে নীল আসমান নিজেকে মানুষ হওয়ার দৌড়ে সামিল করেছে। কাজের অফিসের আর্কিটেক্ট সবিতা দত্ত’র দুঃখের কথা শুনে নীলের চিবুক ভিজে একাকার হয়ে যায়। সোসাইটির বস সরকারের বিরুদ্ধে এবং জমি দিয়ে চাকরি নেওয়া কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ ঘৃণা করেন। চতুর শৃগাল কেমন করে ফাঁদ এড়িয়ে শিকার ধরে ঠিক সেভাবেই সোসাইটির পরিচালক তথা আজন্মকাল বস মানুষকে ফাঁদে ফেলে তার নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতেই থাকে। মাঝে মধ্যে এলাকায় পেলে প্রতারিত মানুষ রেগে গিয়ে গণধোলাইয়ের আয়োজন করলে উল্টে প্রতারিত মানুষরাই কেস খায়। সকলের সাহায্য নিয়ে গড়ে ওঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা এখন হয়ে গেলো বসের আত্মীয়দের লুটেপুটে খাওয়ার সোনার ডিম পাড়া হাস। চোখের জলে বিদায় নেওয়া শিক্ষক থেকে কর্মচারীদের অভিশাপ বসকে তাড়া করে। কলেজ স্কুলের শিক্ষিকা আবেদা সুলতানা থেকে ইরা বেগমকে বিনা দোষে তাড়িয়ে দেওয়া এবং হেনস্তা করার পাপ থেকে মুক্তি পায় না সোসাইটির কর্ণধার নজর মণ্ডল। তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হতে থাকে দিনের আলোয় সাধারণ মানুষের হাতে চরমভাবে অপমানিত হয়ে এবং হেনস্তার শিকার হয়ে।

এক রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল নীলের। ২০০৬ সালের পৌষ মাসের সন্ধ্যা। বেশ শীত শীত ভাব। আর শীতকালে পাড়া গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই মনে হয় গভীর রাত। তখন সন্ধ্যা সাড়ে আটটা হবে। নীল তার অফিস সংলগ্ন ঘরেই ছিল। হঠাৎ মনে হলো বস তো সকালে কলকাতা থেকে এসেছেন। এখন দেখা করলে অনেক দরকারি বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। নীলের ঘর থেকে বসের বাসস্থান দুতিন মিনিটের। নীল দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল। বসের বাড়ির সদর দরজা বলতে একটা বাশের বেড়া। সেটা ঠেলে ধীরে ধীরে বসের বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল নীল।

বস দোতলায় থাকেন। সিড়ির কাছে গিয়ে নীল দেখতে পেল বেশ কয়েক জোড়া চটিজুতো সিড়ির মুখে খুলে রাখা আছে। নীলের মন খুশিতে ভরে উঠল। তাহলে সোসাইটির সদস্যরা এসেছেন দেখা করে আলোচনা করতে। ভালই হবে। সবার সামনে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
নীল আস্তে আস্তে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। বসের ঘরের দরজা কিছুটা ভেজানো। দরজা ঠেলতে গিয়েও একটু থেমে ভেতরের দিকে উকি মেরে দেখতে চাইল কোন কোন সদস্য ভিতরে আছে। কিন্তু কি দেখছে নীল?

ঘরের ভিতরে বসে আছে বসের সব ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নে আর এক বোন। সোসাইটির কোন সদস্য সেখানে নেই। সবাই একাগ্র চিত্তে বসের কথা শুনছে। বস বলে চলেছেন, “এই যে নেফজা (নিফাজ) তোর জন্য আমার মুখ দেখানো ভার। তুই তোলাবাজদের মতো সোসাইটির ক‍্যাশ বাক্স থেকে টাকা তুলে নিচ্ছিস। কত টাকা তুলছিস? দু’হাজার, পাঁচ হাজার বড়জোর দশ হাজার। এতো ফকিরের ভিক্ষা রে। এতে তোদের পেট ভরছে না কিন্তু দূর্নাম হচ্ছে। এই সোসাইটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো তোদের জন‍্যই করেছি, নাকি ওপাড়ার নাজম‍্যার জন্য করেছি? বল, ভেবে বল। কেবলই প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেছে। এখন ধৈর্য ধরতে হবে। এখন যদি পকেটে করে টাকা আনিস তাহলে আর দুবছর পর গাড়িতে করে টাকা আনবি। বুঝেছিস নির্বোধের দল।”

এই পর্যন্ত শুনে নীলের পা কাপতে শুরু করেছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কাল বিলম্ব না করে সে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল। সদর দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে দরজা ঠেলে ভেজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

ঘরে ঢুকে তার মনে হলো তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সে ঢক ঢক করে আধ বোতল জল পান করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। একি দেখল সে! কি শুনল! একি সত্যি নাকি তার মনের ভুল?

৮.
ভুলতে-না-পারা পাপ-কথন। আকাশ-কাড়ার মিছিলে ওরা কারা? ওরা ছুটছে… ওদের বিরামহীন ছুটে-চলা দেখে গর্জে ওঠে নীল আসমানের বিবেক। রুখে দেওয়ার মিছিলে পথ হাঁটে। বিভেদকামী শক্তিকে প্রতিহত করতে লিখে ফেলে মহান সহিষ্ণু উদার ভারত কথা। মা-মাটি-মানুষের মহান নেত্রীর দলের জয় সুনিশ্চিত করতে নীল আসমানও পথে নামে। সক্রিয় সদস্য হয় দলের। পুরনো সরকারকে উৎখাত করতে কলম ধরে। অনেক বছর আগে থেকেই লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করত সে। তার পত্রিকার নামেই প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান থেকে ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মূল্যবান সব গ্রন্থের সম্ভার। সেগুলিও জনমত গড়ে তুলতে থাকে। এরকমই একটি বইয়ের কারণে নীল আসমানের উপর নেমে এলো ক্ষমতাসীনদের অত্যাচার। তার পরিবারের সদস্যদের হতে হলো হেনস্থা। তবুও সে তার লড়াই-সংগ্রাম জারি রাখলো। এমনি করতে করতে ভোট এসে গেল। বিরোধী জোটের পক্ষে গেলো মানুষের রায়। দীর্ঘ অপশাসনের অবসান ঘটাতে নীল আসমানের প্রয়াসও একরকম ইতিহাস হয়ে গেলো। বাংলার মানুষের মনে দাগ কেটে গেল নীল আসমানের কালজয়ী সব প্রয়াস। সুস্থ সমাজ গড়ার অঙ্গিকার নিয়ে সে এগিয়ে এসেছে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে প্রতিনিয়ত।

খোলা জানালায় কত মুখের মিছিল। মার্বেল-শীতল টেবিল আর প্রকৃতির মধ্যে আজও সে খুঁজে ফিরছে নন্দিতা মণ্ডলকে। নীল আসমান খুঁজে ফিরছে আম বাগানের ফাঁক-দিয়ে-দেখা সেই অপরূপা চোখের ইশারায় ফুটে-ওঠা ভালোবাসা। যেন সাতরঙা আবির। বাঁচার আকাশ। এ দেখা কখনও শেষ হয় না নীলের। সে স্বপ্ন দেখে। ছবি আঁকে। হঠাৎ করে তার মনের ক্যানভাস জুড়ে ভেসে ওঠে এ কোন ছবি? কার ছবি? বেলা অবেলায় এ কোন আত্মশুদ্ধি? নন্দিতা, তুমি কোথায়?

শেষ চিঠি আজও পোস্ট করতে পারেনি নীল। হে আকাশচারিণী, মূল্যবান তারা হয়ে জ্বলজ্বল করছ পূব আকাশে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নীল আসমান বলছে, তোমার জন্য এ বুকে আজও আকাশ রাখা। ভালোবাসা তোমার জন্য নিশিযাপন চোখবৃষ্টি থামিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। নন্দিতা… তুমি কোথায় হারালে ! তোমাকে দেখতে না পেয়ে ‘তুমিহীনা এই ছায়াজীবন’ অসহায়। বাংলাদেশর লেখক বন্ধু আহমেদ ফারুকের বই পড়ি বেদনার আকাশ থেকে বেরিয়ে আসতে। জানো হাজারো কাজের পর রাতে বালিশে মাথা রাখি তখন মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য চুল ও কপাল তোমার আঙুলের স্পর্শ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে তুমি আসোনা। হুমায়ূন আহমেদের হিমু সমগ্র পড়তে পড়তেই দুচোখের পাতা মুড়ে আসে।

ভোরের নিস্তব্ধতায়, পিউকাঁহা পাখির ডাকে আজও ঘুম ভাঙে। তখন তুমি দখিনা হাওয়ায় বিছানা ছেড়ে, শীতের চাদর জড়িয়ে চলে আসো আমার কাছে, লাল রঙের সোয়েটার আর কালো শালে শরীর মুড়ে। পরির মতো রাজকন্যা হয়ে। তখনও আধো ঘুমে, ভাঙা স্বপ্নে লীন হতে হতে হাতড়াতে থাকি মাটি। আলতোভাবে হাত রাখো কপালে।

লিচু ফুলে মৌমাছি তখনও খুঁজে ফিরছে মধু। অস্থির চোখে দেখা ঘড়ির চঞ্চল কাঁটা ঘুরে ঘুরে কখন হয়েছে সময়ের নদী। রাজকন্যা, তুমি যেন নদীর গুঞ্জরণে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে আপন মনে গাইছো প্রেমের গান, কল্যাণপুর ষ্টেশনে।

একবার একগুচ্ছ লাল গোলাপ ছাড়াই জানিয়ে ছিলাম ‘একুশের বাংলা ভাষায়’, ভালোবাসি তোমায়।

পরীর মতো রাজকন্যা তখন তুমি ঠায় দাঁড়িয়ে, নির্বাক! আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছো শিমুল পলাশের মাঝে ভালোবাসার রঙ।

নতুন হাতে ড্রাইভিং, কাঁপা কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং…..তুমি পাশের সিটে। সে দিন কি আর কখনো ফিরবে না? নন্দিতা, এই ধর্ম এই সমাজ আমাদের এক হতে দেবে না?

ভালোবাসার আসমান জুড়ে এ কোন ছবি? কার ছবি? বেলা অবেলায় এ কোন আত্মশুদ্ধি?

৯.
হাজার অসহায় মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে থাকে নীল আসমান। সমাজ সেবায় সুনাম অর্জন করেছে নীল আসমান। চারিদিকে তাঁকে নিয়ে এখন চর্চা হতে থাকে। প্রতি মাসে নিজের উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে সে পরিচিত মুখ। প্রতিনিয়ত মুমূর্ষু মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে স্বাস্থ্য শিবির করতে। অসহায় মানুষের পরম বন্ধুর আর এক নাম হয়ে যায় নীল আসমান।

নীল আসমান আবারও স্বপ্নের মধ্যে বিড়বিড় করে– নন্দিতা তোমার জন্য বিস্তীর্ণ আকাশ। দিগন্তব্যাপী খোলা মাঠ। হাতে হাত রেখে প্রাণের বাংলা ভাষাতেই জানাই… ভালোবাসি তোমায়। নন্দিতা তুমি শুধুই আমার। তোমার জন্য, এ বুকে আজও ভালোবাসার আকাশ রাখা। ভালোবাসার জন্য বাঁচো, বাঁচার মতো বাঁচো। অনন্ত ভালোবাসা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। ক্লাসের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকৃতি উদ্যানে অপলক চেয়ে থাকা তোমার চোখ এখনো কি সেই আগের মতো একই রকম আছে! এখনো কি স্বপনের বিভোর হয়ে চমকে ওঠো ঘুমের মধ্যে সেই আগের মতো। আজও কি খবরের কাগজে ছবি দেখে আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করতে চোখে জল চলে আসে। তোমার নীল আসমানকে ছেড়ে চলে গেলে দূরে বহু দূরে আর কি কখনো দেখা হবে না দুজনের। ফিরবে না এ-বুকে আদরহীন শব দেহে হতে হবে লীন।

আমাদের ভালোবাসার একটা চুম্বন অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কখন অপেক্ষালয় হয়েছে জানা হয়নি। তোমার এডমিট নিয়ে দুষ্টুমির জন্য আজও অনুতপ্ত। এই চোখের দিকে তাকাও। অফুরন্ত সৃষ্টি খেলা করে দু’চোখে। মেরো না, বাঁচতে দাও। চেয়ে নাও… মিত্রতা-ভালোবাসা-মনুষ্যত্ব-মানুষ। অবাঞ্ছিত ভেবে ঘৃণা করো না। জেনো অবাঞ্ছিত শুঁয়োপোকা আজও প্রজাপতি হয়।

জানো নন্দিতা, অনেক বছর পেরিয়ে গেল, মানুষ স্বাধীন হয়েছে। আজও আমরা সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ভুবন গড়ে তুলতে পারিনি। বিশ্ব জুড়ে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সম্প্রীতির বন্ধন অগ্রাহ্য করে বেড়ে চলেছে হানাহানি। মানুষ কবে আর মানুষ হবে? প্রকৃতি ব্যুমেরাং। মোকাবিলার বিজ্ঞান কই? তাদের ভেতর তোমাকে হারাতে চাইনা। তুমি জেগে থাকো, চেয়ে থাকো, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকো আমার দিকে, সঙ্গে থাকো ভালবাসার মুহূর্তগুলোকে স্মৃতি করে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। ভালবাসা না পাওয়ার অপূর্ণতায় বেঁচে থাক সন্তানহীন মায়াহীন শরীর জুড়ে।

স্বপ্নের রেশ কাটতে-না-কাটতেই মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে ‘আমারও পরাণ যাহা চায় তুমি তাই…’ শুনে ঘুম ঘুম চোখে বিছানা থেকে উঠে পড়ে নীল। চারিদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন সূর্য দেখা যায় না। মেঘে ঢেকে-রাখা আকাশ। বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়ায় নীল। সে অনুভব করে নন্দিতার ভালোবাসা আকাশ স্পর্শ করে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে… নীল ভিজতে থাকে ভিতর ও বাহিরে।

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD