দক্ষিন দিনাজপুর জেলা প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে অনুষ্টিত হলো “গন কনভেনশন”
নীলাদ্রী শেখর মুখার্জী, দক্ষিন দিনাজপুর
আজ দক্ষিন দিনাজপুর জেলা প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে বালুরঘাটের ঐতিহ্যবাহী নাট্য মন্দিরে “বালুরঘাট তথা জেলার প্রাচীন নিদর্শন গুলির সংরক্ষন” কেন্দ্রিক এক গন কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। এই কনভেনশনে শহরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, গত ৯ ই সেপ্টেম্বর ঐতিহ্যবাহী টাউন ব্যান্ক ভেঙে ফেলা হয়। IBG নিউসের পক্ষ থেকে অন্তর্তদন্ত চালানো হয়।সেখানে মুলত শাসক দলের কিছু নেতার নাম উঠে আসে।এই নিয়ে শহরের বিশিষ্টজনেরা ক্ষোভও প্রকাশ করেন।
এই গন কনভেনশনে (সি পি আই এম) এর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অমিত সরকার, আর এস পি থেকে ছিলেন প্রাক্তন পৌরাধক্ষ্যা সুচেতা বিশ্বাস, ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক রঞ্জন মন্ডল, সর্বভারতীয় তৃনমুল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী সুভাষ চাকী,চেতনা মঞ্চের পক্ষ থেকে ছিলেন জিষ্নু নিয়োগী, AVA এর পক্ষ থেকে ছিলেন প্রদীপ সাহা, পতিরাম নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বজিত প্রামানিক, আংগিনা বার্ডস সংগঠনের পক্ষে বিশ্বজিত বসাক, হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক দীপক মন্ডল, ঐতিহ্যবাহী নাট্য মন্দিরের সভাপতি মিহির দাস, তপন দিঘি ও পরিবেশ সুরক্ষা সমিতি’র পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন অলোক সরকার, হিলি উজ্জীবন সোসাইটির সম্পাদক সুরজ দাস, সীমান্ত উন্নয়ন মন্চের পক্ষ থেকে ছিলেন প্রাক্তন শিক্ষক বিরেন মাহাত প্রমুখরা।এছাড়া প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন সম্পাদক শন্কর রায়। সকলের পক্ষ থেকে জেলা প্রেস ক্লাবকে সাহায্য সহযোগিতা করবেন বলেও জানান তারা।
কনভেনশনের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি শ্রী প্রদীপ পাল। সম্পাদক শ্রী পবিত্র মহন্ত বলেন, “গত কিছু দিন আগে আমরা দেখলাম শহরের ঐতিহ্যবাহী টাউন ব্যান্ক ভেঙে ফেলা হল রাতের অন্ধকারে। কিন্তু তা শত চেষ্টা করেও আমরা আটকাতে পারিনি। এই হেরিটেজগুলি যেন আর না ভান্গা হয় তার জন্য আমরা বিদগ্ধজনেদের মতামত নিয়ে একটি প্রোফাইল বানিয়ে তা জেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে তা পেশ করবো।”
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা জরুরি, দক্ষিন দিনাজপুর জেলা ঐতিহ্যবাহী জেলা। এই জেলায় বিভিন্ন ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু ঐতিহ্যবাহী মন্দির, মসজিদ, স্মৃতিসৌধ। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় শতাধিক ঐতিহ্যবাহী ভবন রয়েছে। সেগুলির একটিও অবশ্য হেরিটেজ তকমা পায়নি। কিন্তু সেগুলি ভেঙে ফেলায় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। বালুরঘাটের চ্যাটার্জি বাড়িতে নেতাজি সুভাষ বসু রাত্রিযাপন করেছিলেন। বছর দশক আগে প্রোমোটারদের চক্করে সেই বাড়ির অর্ধেক অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি ফের একবার বালুরঘাটের শতাব্দী প্রাচীন টাউন ব্যাঙ্ক ভেঙে ফেলা হয়েছে। এনিয়ে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। তাঁরা ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিংগুলিকে রক্ষা করার জোরালো দাবি জানিয়েছেন। এবিষয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) বিবেক কুমার বলেন, সম্প্রতি বালুরঘাটের পুরনো টাউন ব্যাঙ্ক ভেঙে ফেলার কথা শুনেছি। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। পাশাপাশি বালুরঘাট সহ জেলায় যে সমস্ত পুরনো বিল্ডিং রয়েছে, তার একটা তালিকা তৈরি করে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠাব। যাতে হেরিটেজ ঘোষণার পাশাপাশি সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। সেজন্য প্রয়োজনীয় যা পদক্ষেপ করা দরকার, আমরা নেব।
এবিষয়ে বালুরঘাটের ইতিহাসবিদ সমিত ঘোষ বলেন, নগরায়ণকে মেনে নিতেই হবে। প্রোমোটাররা ব্যবসা করবেন, উন্নয়নও চলবে। কিন্তু শহরের গুটিকয়েক ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিংকে বাদ দিয়ে নগরায়ণ হোক। না হলে আমাদের শহর ও জেলার ঐতিহ্যগুলি আগামী প্রজন্মের জন্য থাকবে না। প্রয়োজনে শহরের পুরনো বিল্ডিংগুলিতেই সরকারি অফিস হোক। তবুও সেগুলি রক্ষা পাবে।
দক্ষিণ দিনাজপুর হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক দীপক মণ্ডল বলেন, বালুরঘাট শহর তথা গোটা জেলায় ছোট বড় নানা ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিং ও ঐতিহাসিক সৌধ রয়েছে। সেগুলি নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি টাউন ব্যাঙ্কটিকেও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমাদের কিছুই করার থাকল না। তাই প্রশাসন যাতে দ্রুত এই বিল্ডিংগুলিকে হেরিটেজ ঘোষণা করে, সেই দাবি জানানো হয়েছে।
বালুরঘাট শহর নানা ইতিহাস ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সাক্ষী। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও নাটকে বিখ্যাত বলে এই শহরকে ‘থিয়েটারের শহর’ বলা হয়। বালুরঘাট শহরে ইংরেজ ও প্রাচীন কালের নানা বিল্ডিং ও ইতিহাসের নিদর্শন রয়েছে। নাট্যমন্দির, মুন্সেফ কোর্ট, ট্রেজারি বিল্ডিং, কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক, তেভাগার স্মৃতি বিজড়িত পুরনো হাসপাতাল, মন্মথ রায়ের বাড়ি, নেতাজি স্মৃতি বিজড়িত সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি সহ নানা ভবন রয়েছে। যেগুলি দিনের পর দিন একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেগুলির মালিক কে বা কারা, তা কোনওদিনই নজরে আসে না। কিন্তু হঠাৎ করে সেই বিল্ডিংগুলির মালিক বেরিয়ে আসছে।
শতাব্দী প্রাচীন টাউন ব্যাঙ্ককেও রাতারাতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও নেতাজির রাত কাটানো সেই বাড়ির অর্ধেক অংশ ভাঙা হয়েছে। এছাড়া হিলির ঐতিহ্যবাহী গ্যারেটি ব্রিজ ভেঙে নতুন করে গড়া হয়েছে। বালুরঘাট জেলা প্রশাসনিক ভবনের ভিতরেও ৪২-এর আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ ভেঙে সেখানে নতুন ভবন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জেলাজুড়ে এমন বহু ঐতিহাসিক বিল্ডিং রয়েছে। যা মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। যেগুলি রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রোমোটারদের থাবায় হারিয়ে যেতে বসেছে। শহরবাসীর আশঙ্কা, দ্রুত সেগুলিকে হেরিটেজ তকমা না দিলে, আগামী দিনে সবকিছুই একের পর এক হারিয়ে যাবে। বালুরঘাট শহরটিও ‘ঐতিহ্যবাহী’ তকমা হারাবে।