ভাদ্র সংক্রান্তির, রাঢ় বাংলার ভাদু সংস্কৃতি

0
934
Tribal Dance
Tribal Dance
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:10 Minute, 44 Second

ভাদ্র সংক্রান্তির, রাঢ় বাংলার ভাদু সংস্কৃতি

ভাদর মাসে ভাদু পুজা..ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে … মানভূমের ভাদু উৎসব। ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসবে পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। তা-ও বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসে। বর্ষা উৎসবের এই করম গানের হিন্দু সংস্করণ হিসেবে ভাদু গানকে ধরেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি ভাদু গানকে আর্যেতর সমাজ উদ্ভূত ধরে, হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার প্রভাবজাত বলেছেন।

বর্ধমান জেলার ‘বর্ধমান ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব চর্চাকেন্দ্র’-র কাছে ‘রাঢ় বাংলার ভাদু গান’ নিয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি একাধিক বার। খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি ভাদু গানের উৎস।
ভাদু গান-কেন্দ্রিক লোক-উ়ৎসব। সে উৎসবের উৎস খুঁজতে গিয়ে পেয়েছি, নানা কিংবদন্তি। বিভিন্ন গবেষক, লেখক, ভাদু শিল্পীদের দেওয়া তথ্যানুসারে কিংবদন্তির বিভিন্ন রূপ কেমন? ভাদুই বা কে? এ নিয়ে নানা কিংবদন্তী রয়েছে। যেমন, অনেকে মনে করেন ‘ভাদ্র’ মাস থেকে ভাদু শব্দটি এসেছে। আবার কেউ বলেন, ভাদু মানে লক্ষ্মী। যে হেতু লক্ষ্মী বিভিন্ন সময়ে পূজিত হন, তাই ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করার জন্য ভাদু পুজোর প্রচলন হয়। অন্য মতও রয়েছে। সেই মতে ভাদুর সঙ্গে বাস্তবের কাহিনি জড়িয়ে আছে।

এই মতে ভদ্রাবতীর সংক্ষিপ্ত নাম ভাদু। তিনি পুরুলিয়ার এক রাজা নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা। তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির এক জনকে ভালবাসতেন। পিতা মেনে নিতে পারেননি। তাই ভাদু আত্মহত্যা করেন। রাজা মেয়ের স্মৃতিতে শুরু করেন ভাদু পুজো। কেউ কেউ বলেন প্রেম নয়, ভাদু ব্যাধির কারণে মৃত্যুবরণ করেন। রাজা মেয়েকে হারিয়ে তাঁর নামে চালু করেন স্মৃতি-তর্পণ।

আবার এক মতে, ভাদু কাশীপুরের রাজার মেয়ে। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানের রাজকুমারের সঙ্গে। বিয়ের দিন বর বেশে যাত্রা পথে রাজকুমারের ম়ৃত্যু ঘটে লেঠেলদের হাতে। ভাদু আত্মহত্যা করেন। অনেকে আবার ভাদুর সঙ্গে মীরাবাই-এর মিল পান। সে খানে রাজকন্যা ভাদু, জন্ম থেকে তিনি মীরার মতো কৃষ্ণভক্তি পরায়ণা। রাজা তাঁর বিবাহ ঠিক করলে ভাদু মন্দিরে নিজের প্রাণ ধ্যানস্থ অবস্থায় ত্যাগ করেন। কেউ কেউ ভাদুকে বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের কন্যা ভদ্রাবতী বলে মনে করেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে ভাদু পুজোর প্রচলন।

অনেকের মতে সাঁজপুজুনি, পুণ্যিপুকুরের মতো না হলেও এয়োস্ত্রী মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে সংসার জীবনে সুস্থ থাকার জন্য এ এক ধর্মীয় ব্রত। কেউ কেউ বলেন ভাদু বীরভূমের সন্তান। তাই বীরভূমে ভাদু পুজোর এত প্রসার। আবার বর্ধমানের সঙ্গে ভাদুর যোগ খুঁজে পান কেউ কেউ। অবিভক্ত বর্ধমানের খনি অঞ্চলে ‘ভাদা গান’ বলে একটি লোক-সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। এখনও কিছু কিছু জায়গায় তার প্রচলন রয়েছে। তার নামে ভাদু পুজো।

উপরের এই সব মত থেকে নানা প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন ভাদ্র মাস থেকে কি ভাদু পুজো? সত্যের খোঁজ পাওয়া ভার। কারণ, সব লোক- উৎসবের সঙ্গে মাসের নাম জড়িয়ে থাকে এমনটা নয়।

ভদ্রাবতী সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি পুরুলিয়ার রঘুনাথগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত কাশীপুরের রাজা নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা। তাঁর মায়ের নাম অনুপকুমারী বা কলাবতী। যদিও অনেকের মতে দু’টি নামই একই ব্যক্তির। স্থানীয় গবেষকদের অনুমান, ভদ্রাবতীর জন্ম ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে। যদিও পঞ্চকোট রাজবংশলতিকায় ভদ্রাবতীর নাম নেই। কিন্তু নীলমণি সিংহদেওয়ের নাম রয়েছে। গবেষকদের একাংশের দাবি, ভদ্রাবতী ১৭ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৮৫৮ সালে বিয়ের আগের দিন কোনও এক আকস্মিক কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে রাজা শোকাহত হয়ে পড়েন। প্রজাকুলের ইচ্ছায় মিত্র-মন্ত্রীদের সহযোগিতায় শুরু হয় ভাদুর স্মৃতি তর্পণ।

এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, ভাদুর জন্ম এবং মৃত্যু দুই-ই ভাদ্র মাসে। তাই ভাদ্র মাসে হিন্দুদের কোনও বিবাহ থাকে না। তবুও একটা প্রশ্ন জাগে যেখানে পঞ্চকোট রাজবংশের বংশলতিকায় ভাদুর নাম নেই, সেখানে কি করে বোঝা যায় যে ভাদু নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা? পুরুলিয়ার কিছু গবেষক যেমন সুনীল মাহাতো, হারাধন মাহাতো, রবীনকুমার পান্ডে, ভোলানাথ চক্রবর্তী, মৌসুমী কোলে এবং ভাদু শিল্পী ও লেখক গিয়াসুদ্দিন শেখ, বংশধর সিংহ—এদের প্রত্যেককে এই প্রশ্ন করে যে জবাব পাওয়া যায়, তা হল—যদি ভদ্রাবতীর পিতা নীলমণি না-ই হবেন, তবে এত দিন ধরে তাঁদের বাবা-মেয়ের নামে গান বাঁধা হচ্ছে কেন? নীলমণি তো কাল্পনিক চরিত্র নন।

ধর্মীয় মতে ভাদ্র মাসে যে রমণী লক্ষ্মীপুজো করেন তাঁর উপরে যশোলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী প্রসন্ন হন। সেই সূত্রে মনে হয়, ভাদু আসলে শস্যদেবী। ধান ওঠার ফলে চাষিদের ঘরে শস্য বন্দনার যে রেওয়াজ ছিল, তা নানা বিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠে ভাদুদেবী রূপে।

পুরুলিয়া জেলার এক অন্যতম উৎসব ভাদু পুজো । প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মহিলারা ভাদ্র মাস জুড়ে ভাদুর পুজো করে থাকেন। আজ সংক্রান্তি অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিনে বৃহস্পতিবার সারারাত ধরে ভাদু গানের জাগরণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় পুরুলিয়ার ভাদুর পরব।

রাতভর ভাদুর জাগরণের পর আজ সকালে হয় ভাদুর বিসর্জন। ভাদুর পুজোর প্রসাদ হিসেবে থাকে থালা ভর্তি নানারকমের মিষ্টি। এ পুজোর প্রধান উপকরণ খাজা,গজা লং,এবং জিলিপি। এ দিন মিষ্টির দোকানে বড়ো বড়ো আকারের জিলিপি বিক্রি হয়। অনেকটা ঠিক জিলিপি প্রতিযোগিতার মত। সেই মতো সাত দিন আগে থাকতেই খাজা গজা জিলিপি তৈরিতে ব্যস্ত মিষ্টির দোকানের কারিগরেরা।
খুব সংক্ষিপ্তভাবে বললে, সমগ্র ছোটনাগপুর অঞ্চল তথা পুরুলিয়া জেলায় ভাদু পুজোর ইতিহাস বলছে, ভাদু বা ভদ্রাবতী ছিলেন পুরুলিয়ার কাশিপুরের রাজপরিবারের কন্যা। তার অকাল মৃত্যুতে তৎকালীন শোকার্ত রাজা ভাদুর পুজো শুরু করেছিলেন। সেই থেকে আজও চলে আসছে ভাদুর পুজো। যা পুরুলিয়া জেলায় অন্যতম লোকসংস্কৃতির মর্যাদা পেয়েছে।

এই উৎসব উপলক্ষে, পুরুলিয়া জেলার প্রায় প্রতিটি মিষ্টির দোকানের সামনেই সাজানো হয় খাজা গজা এবং জিলিপি। ভাদু পুজো উপলক্ষ্যে তৈরী করা হয় নানা মিষ্টি।

তবে লোকসংস্কৃতি গবেষকরা বলেন অন্য কথা। ভাদু হলেন শস্যের দেবী। ভালো শস্যের জন্যই ভাদুর আরাধনা হয়ে থাকে বলে প্রচলিত মত রয়েছে। তবে মতামত যাই থাকুক রাঢ় বাংলার কৃষক পরিবারগুলির কাছে ভাদু পুজো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Prasanta Das
Prasanta Das

Author

প্রশান্ত দাস মতিঝিল কলেজে অ্যাডমিন বিভাগের দ্বায়িত্বপূর্ন পদে কর্মরত । নানা বিষয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন , নতুন নতুন রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট , বাগান ও পরিবেশ সচেতন নাগরিক ও ছাত্রদরদী সোশিওলজির শিক্ষক ।

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD