আজাহারউদ্দীন খান এর স্মরণসভা
শামিম সাইফুল্লাহ
উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে, বাংলা সাহিত্য ডট ইন এর যান্ত্রিক সহযোগিতায় ১ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার ভার্চুয়াল মোডে অনুষ্ঠিত হয় সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক আজাহরউদ্দীন খানের স্মরণ অনুষ্ঠান। স্মৃতিচারণা ও মননের গহীনে আবগাহন; এই দুই পর্বে বিন্যস্ত করা হয় সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি। স্মৃতিচারণা পর্বে আলোচনায় অংশ নেন পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরান, নতুন গতি পত্রিকার সম্পাদক এমদাদুল হক নূর, অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার, অধ্যাপক স’আদুল ইসলাম, অধ্যাপক আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক মীর রেজাউল করিম, অধ্যাপক শেখ মকবুল ইসলাম।
আজাহারউদ্দীন খানের মননলোকের উপর আলোকপাত করেন প্রাজ্ঞব্যক্তিত্ব জাহিরুল হাসান ও আজাহারউদ্দীন খান গবেষক অশোক পাল।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আজহারউদ্দীন খানের দুই পুত্র আসিফ খান ও আরিফ খান। তাঁদের নিজস্ব কথন ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। সভামুখ্যের দায়িত্বে ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মইনুল হাসান। সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক শামিম সাইফুল্লাহ এবং উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনার সম্পাদক ফারুক আহমেদ।
আজহারউদ্দীন খান তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষা। তাঁর মন-মননের সমস্তটা জুড়ে ছিল বাঙালিয়ানা ও বাংলা সাহিত্য। তিনি প্রথম দিন থেকে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। নজরুল গবেষক হিসাবে তাঁর পরিচিতি সর্বাত্মক। বাংলা সাহিত্যে নজরুল বহু চর্চিত ও পঠিত গ্রন্থ। তিনি গবেষণামূলক লেখালিখি করেছেন সেইসব বরেণ্য সাহিত্য ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে যাঁরা দেশভাগের পরে এপার বাংলায় বিস্মৃত প্রায় হয়ে উঠেছিলেন—কবি বন্দে আলি মিয়া, শাহাদাৎ হোসেন যেমন। মুখ্যত তাঁর কৃতির পথ ধরেই আমরা এঁদের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। দীপ্ত আরো বন্যা বুধমণ্ডলীতে বিশেষভাবে সমাদৃত তাঁর অপর একটি গ্রন্থ। এখানে রয়েছে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুলহাই, মুনীর চৌধুরীর মতো কালজয়ী ব্যক্তিত্বদের উপর তথ্যবহুল আলোচনা। আজহারউদ্দীন খান সম্পাদনা করেছেন কয়েকটি অসামান্য গ্রন্থ। –আলোচনার আসরে পরিবেশিত হয় এসব কথা।
তাত্ত্বিক কথার সমান্তরালে আলোচকবৃন্দ আলোকপাত করেন আজহারউদ্দীন খানের ব্যক্তিগত জীবনবৃত্তের উপর। পুথিগতবিদ্যার বহর প্রসারিত হয়নি অধিক দূর পর্যন্ত। স্নাতক পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ার আগেই পড়াশুনায় ছেদ পড়েছিল। প্রথম জীবনে জীবিকার জন্য তিনি বেছে নেন শিক্ষকতাকে। পরে পড়াশুনা করার বিশেষ সুবিধা হবে এই ভাবনা থেকে গ্রন্থাগারিকের চাকুরিতে নীত হন এবং কর্মজীবনের শেষদিন পর্যন্ত ওই পেশাতেই স্থিত ছিলেন। মাক্সীয় ভাবাদর্শের উপর ছিল তাঁর বিশেষ আনুগত্য। তবে সেই অর্থে কখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। বৌদ্ধিকক্ষেত্রে মার্ক্সীয় ভাবাদর্শের উপর ছিল তাঁর বিশেষ আনুগত্য। তবে সেই অর্থে কখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। বৌদ্ধিক্ষেত্রে মার্ক্সীয় ভাবনার ফসল ফরানো ছিল তাঁর লক্ষ্য। সেদিন পরিস্থিতি এমন ছিল, যে বাঙালি মুসলমান সমাজ ও তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের চর্চা করা মোটেই সুবিধাজনক ছিল না। এমন প্রতিকূল অবস্থার বিপরীতে তিনি শেষদিন পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন; নিরবচ্ছিন্ন ছিল তাঁর সৃষ্টিধারা। কোনো অন্যায়, অনৈতিক চাপের কাছে তিনি নতিস্বীকার করেননি, ব্যক্তিগত বিবেকের পর্দায় যা সত্য বলে প্রতিবিম্বিত হয়েছে সে সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ করেছেন। –এসব বৃত্তান্ত ফিরে ফিরে আসে আলোচকদের কথায়।
জীবনের শেষ দশ বছর মোটের উপর নিস্ফলা কাটে আজহারউদ্দীন খান মহাশয়ের। এক পারিবারিক দুর্ঘটনায় শোকস্তব্ধ তিনি সেই যে লেখালিখি বন্ধ করেছিলেন তা আর চালু করেননি। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সাপেক্ষে এ এক বেদনাবিধুর বৃত্তান্ত বলে সভায় মত প্রকাশ করা হয়।
আজহারউদ্দীনের স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁকে ঘিরে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ ও একটি গবেষণা পরিষদ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যান্ত্রিক কারণে অধ্যাপক লায়েক আলি খান ও লেখক একরামূল হক শেখ আলোচনায় অংশ নিতে পারেননি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কলকাতার সুপ্রিম পাবলিশার্স ও মেদিনীপুরের সৃজন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত আজহারউদ্দীন খানের বিভিন্ন গ্রন্থ এখন সংগ্রহযোগ্য।