|| চেনা অচেনা ইতিহাসের খোঁজে – দিব্যক স্তম্ভ: বাঙালির পূর্বজদের বীরত্বগাঁথা||
Location:
~দিবর স্তম্ভ বা দিব্যক জয়স্তম্ভ বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থানার দিবর দিঘীর মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন।~
অবশেষে দেখা হল! যাবো, যাবো করে বারবারই প্ল্যান চেঞ্জ করেছি বিভিন্ন কারণে। ১০/১০/২০২০ তারিখটি ম্যাজিকাল হলো আমার জন্য। হুট করেই প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে দুপুর তিনটায়, অলরেডি লেট! ৩৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আগ্রাদ্বিগুণ দেখা শেষ করতেই বিকাল ৫টা। দিবর দিঘী আগ্রাদ্বিগুণ থেকে প্রায় ১৭ কি:মি:। যখন দিবর দিঘী থেকে ২ কি:মি: দূরে তখন ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমেছে। দিবর দিঘীতে পৌঁছে দেখি সন্ধ্যা উত্তীর্ণ! চারিদিকে অন্ধকার।
ঝটপট কয়েকটা ছবি নিলাম দূর থেকে, নাইট মুড অন করে। আশ মিটলো না দূর থেকে সন্ধ্যার আবছায়া আলোয় দেখে। দিঘীতে বাঁধা নৌকা চোখে পড়ল, মাঝিরও দেখা মিললো। ৫ গুণ ভাড়া দিয়ে রাজী করালাম নিয়ে যেতে স্তম্ভের কাছে। কাছে গিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম স্তম্ভটি। অবর্ণনীয় এক অনুভূতি! এই হল বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। মাথা উঁচিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কত শতাব্দী ধরে। সান্ধ্য প্রণতি হে পূর্বজগণ!
পাল শাসনামলে ধীবর ও অন্যান্য অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের বিদ্রোহই সম্ভবত প্রথম ও সফল বিদ্রোহ। পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বৌদ্ধধর্মে প্রাণীহত্যা নিষেধ হওয়ায় এসময় মাছ শিকার ও ভক্ষণে বাধা দেয়া হতে থাকে। এতে ধীবর (জেলে) সম্প্রদায়রা বিপদে পড়ে এবং কষ্টে দিনযাপন করতে থাকে। ফলে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। এদিকে দ্বিতীয় মহীপাল দূর্বল ও অযোগ্য শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনামলে অন্যান জনগণ, এমনকি মন্ত্রী ও সেনাপতিরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
দিব্ব্যোক পাল রাজদরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। জনমনে ক্ষোভের উত্তাপ তিনি ভালোই অনুভব করছিলেন, বিশেষত স্বজাতির দুর্দশা তাঁর অজ্ঞাত ছিলো না। কিন্তু অযোগ্য মহীপাল কারুর কথায় কর্ণপাত করেন নি।
রামচরিতের ১/৩১ শ্লোকের টীকা থেকে মহীপাল ও অনন্ত সামন্তচক্রের যুদ্ধের কথা জানা যায়। অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করতে আসা মহীপাল পরাজিত ও নিহত হন। রামপাল এসময় স্বজনদের নিয়ে রাষ্ট্রকূট রাজ্যে চলে যান। সামন্তচক্র বুঝতে পারেন, সঠিক হাতে ক্ষমতা না দিলে রাজ্যে শৃঙ্খলা আসবে না। তাই সবার মনোনয়নে সিংহাসনে বসেন দিব্ব্যোক।
স্যার যদুনাথ সরকার ভোজবর্মার তাম্রশাসনের ৮ম শ্লোকের ভিত্তিতে মন্তব্য করেছেন: দিব্যের বীর বলিয়া এত বেশি সুনাম ছিল যে লোকে তাহা একটা উপমার কথা মনে করিত, যেন তিনি বীরত্বের সীমা, ইহার বেশি বীর কেহই হইতে পারে না। তিনি মহীপালের পিতা বিগ্রহপালের সময় প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন।
স্যার যদুনাথ সরকার আরও মত প্রকাশ করেছেন, “দিব্য এমন সাধুপুরুষ যে অত অবহেলা অত্যাচার পাইয়াও নিজের মনিব মহীপালকে রাজ্যলোভে বা প্রতিহিংসার রাগে আক্রমণ করেন নাই। যখন মহীপালের শাসন প্রজাদের অসহ্য হইয়া উঠিল, যখন দিব্য দেখিলেন যে দেশ উদ্ধার, লোকের মান-সম্ভ্রম রক্ষা করা তাহারই কর্তব্য, তখন তিনি বিদ্রোহী দলে যোগ দিলেন”।
শ্রী রমাপ্রসাদ চন্দও একই মত পোষণ করে বলেছেন, “দিব্যের বিদ্রোহ করিবার প্রবৃত্তি ছিল না। ঘটনাচক্রে অবশ্য কর্তব্য বলিয়া তিনি রাজদ্রোহ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।”
এতো গেল দিব্ব্যোকের ক্ষমতা লাভের কথা। এখন আসা যাক দিব্যক স্তম্ভের কথায়।
দিবর স্তম্ভ বা দিব্যক জয়স্তম্ভ বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থানার দিবর দিঘীর মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ দিঘী স্থানীয় জনগনের কাছে কর্মকারের জলাশয় নামে পরিচিত। দিঘীটি ৪০/৫০ বিঘা বা ১/২ বর্গ মাইল জমির উপর অবস্থিত। দিবর দিঘীর মধ্যস্থলে অবস্থিত আটকোণ বিশিষ্ট গ্রানাইট পাথরের এতবড় স্তম্ভ বাংলাদেশে বিরল।
এ স্তম্ভের সর্বমোট উচ্চতা ৩১ ফুট। পানির উপরে ১০ ফুট, পানির নীচে ১০ ফুট ও পানির নীচে মাটির মধ্যে প্রোথিত ১১ ফুট। এ স্তম্ভে কোন লিপি নেই। স্তম্ভের উপরিভাগ খাঁজ কাটা অলঙ্করণ দ্বারা সুশোভিত।
দিবর দিঘীর মধ্যস্থিত জয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ৩টি পৃথক মত পাওয়া যায়:
এক: দ্বিতীয় মহীপাল কে পরাজিত ও হত্যা করার সাফল্য কে স্মরণীয় করে রাখতে দিব্যক এ জয় স্তম্ভ নির্মাণ করেন। দীনেশ চন্দ্র সেন “বৃহৎ বঙ্গ” গ্রন্থে লিখেছেন – “কৈবর্তরাজ ভীমের খুল্ল পিতামহ দিব্বোক দ্বিতীয় মহিপাল কে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিয়া বিজয়োল্লাসে যে স্তম্ভ উত্থাপিত করিয়াছিলেন তাহা এখনও রাজশাহী জেলার এক দিঘীর উপরে মস্তক উত্তোলন করিয়া বিদ্যমান”। উল্লেখ্য পূর্বে নওগাঁ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল।
দুই: দিব্যকের রাজত্ব কালে পাল যুবরাজ রামপাল বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টা করে দিব্যক এর নিকট পরাজিত হন। দিব্যক এই সাফল্যের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে দিঘীর মধ্যস্থিত এ স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতের পরিচিতি পর্বে অনুবাদক বিজয় স্তম্ভ নির্মাণের করন সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন : “পূর্ববঙ্গের ভোজ বর্মার তাম্রশাসন হইতে জানা যায় দিব্যের বীরত্ব খ্যাতি তৎকালে উপমার বিষয় ছিল। অত্যল্পকালই বরেন্দ্রী দিব্যের রক্ষণাধীন থাকে। পূর্বোদ্ধৃত মনহলি লিপির ১৪শ শ্লোক ও রামচরিতের ১/২৯ শ্লোক একত্রে পাঠ করিলে জানা যায় দিব্যের রাজত্বকালে রামপাল (১০৮২ – ১১২৪) একবার পিতৃরাজ্য উদ্ধারে সচেষ্ট হইয়া ব্যর্থকাম হন। দিনাজপুর জেলার (বর্তমানে নওগাঁ) দিবর দিঘী নামক জলাশয় ও তন্মধ্যস্থিত শিলাস্তম্ভ আজও তাহার স্মৃতি রক্ষা করিতেছে”।
তিন: ভীম এ স্তম্ভটি নির্মাণ করেন এবং পিতৃব্য স্মৃতি রক্ষার্থে স্তম্ভটি তার নামে উৎসর্গ করেন। অধ্যাপক শিরিন আখতারের বিবরনে তার সমর্থন পাওয়া যায়। যে উদ্দেশ্যেই এ স্তম্ভটি নির্মিত হোক না কেন, এই দিবর দিঘী নামক জলাশয় ও তন্মধ্যস্থিত শিলাস্তম্ভটি দিব্যকের স্মৃতি অম্লান করে রেখেছে।
বর্তমান মুর্শিদাবাদে সাগরদিঘীতেও দিব্যকের অভিযান হয়েছিল এবং সেই স্থানে একটি বিজয়স্তম্ভ প্রোথিত হয়। রামপাল কর্তৃক সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের পরে এটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
দিব্ব্যোক সম্পর্কে সোমব্রত সরকারের লেখা “দুই বাংলার বাউল আখড়া” বইয়ের সামান্য অংশ খুবই প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করলাম:
বরেন্দ্র কৈবর্ত্যনায়ক দিব্যোক পাল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করে তখনই বরেন্দ্র ভূমিতে কৈবর্ত্যাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পাল রাজসভার সভাকবি ছিলেন সন্ধ্যাকর নন্দী। স্বভাবতই তিনি রামচরিত এর পাতায় দিব্যোকদের বিদ্রোহকে হেয় প্রতিপন্ন করবেনই। কবিমশাই তাই দিব্যোককে দস্যু আখ্যা দিলেন। প্রজাবিদ্রোহকে ধর্মবিপ্লব বলে দেগে দিয়ে তিনি ভরস্য আপদম বলে বর্ণনা রাখলেন ‘রামচরিত’ এর পাতায়। বিকৃত হল ইতিহাস। বাঙালি ধরতেই পারল না ঠিক ভাবে, এগারো শতকে কৈবর্ত্যদের গণবিদ্রোহের উত্তাপ। সন্ধ্যাকর দিব্যোকের সামাজিক অবস্থান, বৃত্তি সব বেমালুম চেপে গেলেন। বললেন না তাঁর নামিত এই দস্যু সমাজের প্রতিনিধিরাই এগারো বারো শতকে গোটা বাংলা জমি জুড়ে কেবট্ট নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এঁদের কেউ কেউ শিক্ষিত ছিলেন, সংস্কৃত চর্চা করতেন, কবিতাও লিখতেন। ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ নামক সংকলিত কাব্যগ্রন্থে পপীপ রচিত একখানি পদও বর্তমান। পপীপ জাতে ছিলেন কৈবর্ত শিক্ষিত উচ্চবর্ণের ভাগ করা লোকায়ত বাংলার প্রতিনিধি। জীবিকা বৃত্তির দিক থেকে কৃষক ও জেলে সমাজের প্রতিনিধি।
সন্ধ্যাকরের রাজ সন্তুষ্টির ব্যাপার ছিল। সেজন্যই তিনি পাল রাজবংশের জয়গান গাইতেই ব্যস্ত ছিলেন। রাজবংশের আভ্যন্তরীণ অন্তর্দন্দ্ব; মহীপালের নির্বুদ্ধিতা, রামপালের বিচক্ষণতা– এসব বোঝাতেই তিনি ব্যস্ত। রামচরিত লিখতে বসেছেন তিনি। তাই রামপালের বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা–পাল রাজাদের সেনাবাহিনীর পক্ষে এই বিদ্রোহ দমন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বুঝে নানান ছোট বড় রাজা ও সামন্ত সৈন্য সংগ্রহ করে সেই বিদ্রোহ দমনের কাহিনী লিখতে গিয়ে সন্ধ্যাকর এটা অবশ্য বুঝিয়ে দিলেন যে, কৈবর্ত্য সংগঠন কী বিপুল জোরদার ছিল।
দিব্যোকের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রুদোক, রুদোকের পর তাঁর ছেলে ভীম। দ্বিতীয় মহীপাল যখন দিব্যোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন, তখন তাঁর দুই ভাই শুরপাল ও রামপাল কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে পালবংশের অধিকৃত এক অংশে রাজত্ব করতে থাকেন। এরপর দিব্যোকের উৎখাতের জন্য সৈন্য সংগ্রহ, শুরপালের মৃত্যু, রামপালের সিংহাসনে বসা, মগধ, ওড়িশা, বরেন্দ্ৰজমি, দণ্ডভুক্তি বা হালের মেদিনীপুর, বগড়ী বা নতুন গড়বেতা, কুজটি বা গালভরা সাঁওতাল পরগনা সহ বিস্তীর্ণ এলাকার সামন্ত রাজাদের এক করে কৈবৰ্তরাজ ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষমেশ তাঁকে বন্দী করে, তাঁর পরিবারবর্গকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কৈবর্ত্যদের বরেন্দ্রভূমি থেকেই বলা চলে একেবারে উৎখাত করেন রামপাল।
সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিত এর পাতায় সেই জয়গানই গেয়েছেন। কিন্তু লোকায়ত তথা নীচু মানুষদের গন অভ্যুত্থানকে যতটা সম্ভব হেয় প্রতিপন্ন করে বেমালুম চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, যেটুকু যা বেড়িয়ে পড়েছে তা তাঁর ওই কলম চালানোর অসতর্কতায়। আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই সম্পাদনাকালে দৃষ্টিগোচরে এনেছেন বিষয়টি। শিক্ষিত বাঙালি তাই প্রামান্যের নথিকে আর অস্বীকার করতেই পারেনি।
দিব্যক স্তম্ভ নিঃসন্দেহে বরেন্দ্রবাসীদের একটি গর্ব। কৈবর্ত রাজাদের অনেক জনহিতৈষী কাজ আজো চোখে পড়ে। কতশত পুকুর ও দীঘি খনন করেছিলেন তাঁরা বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির কষ্ট দূর করতে। ভীমের জাঙ্গাল এমনই একটি বিশাল কীর্তি। শত কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মিত বন্যারোধী বাঁধের চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। যাইহোক, দিব্যক স্তম্ভ ভ্রমণ আমার জন্য একটা বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র:
১. রামচরিতম, সন্ধ্যাকর নন্দী
২. দুই বাংলার বাউল আখড়া, সোমব্রত সরকার
৩. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান
৪. পত্নীতলা উপজেলার ওয়েবসাইট
৫. মহারাজা দিব্য, অযোধ্যানাথ বিদ্যাবিনোদ
The author is one of the popular bloggers at Shahriar’s Scrapbook, works as a Learning and development professional, fond of reading books, exploring places, and in love with literature, history, and archaeology. Interest in Exploring Places, Book Reading, Knowing People, Folklore, Management, Coaching, History, Literature, Archaeology and Human Connection. He is the director at Omnisource Bangladesh.
Published with Author’s approval and consent.
লেখাটি ব্লগেও পড়তে পারেন:
https://shahriar-scrapbook.blogspot.com/
©️ Shahriar’s Scrapbook