স্বপ্ন
ড: পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার ছোটবেলার,তখন বোধহয় দুবছর, অনেকটা সময় কেটেছিল রুক্ষ মাটির দেশে।
সেখানে গরমকালে জল থাকত না। লু বইত। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে পাখা চলত না দিনে রাতে।
সেই রুক্ষতার দেশে ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে ছোট ছোট ইউক্যালিপটাসের চারা গজাতে দেখেছিলাম।
সে চারার কথা মনে আছে।
চার বছর বয়সে বাসা থেকে বহুদূরে মাঠ পেরিয়ে সপ্তাহে একদিন করে মুস্তাফার কাছে খাসির মাংস আনতে যেতাম একা একা। বেশিরভাগ দিনই আড়াইশো গ্রাম মাংস চাইছি শুনে খুব একচোট হেসেও মুস্তাফা মাংস দিয়ে দিত আমায়।
তাকে কাকু বলতাম না। নাম ধরে ডাকতাম।তাতে আরো খুব একচোট হাসতো সে..।
এরপর ছ বছর বয়স হয়ে গেল।
তখন যেখানে থাকতাম সেখানে খুব সাপের আড্ডা।
বাবা কাজে বেরোতো আর মা পাহারা দিত দুপুর জাগা আমাকে।
রোজ দুপুরে মায়ের চোখ ঘুমে টেনে এলে
বাসার পিছনের বারোমেসে পেয়ারা গাছ থেকে কষি কাঁচা পেয়ারা ছিঁড়ে চেবাতাম।
সাপেরা তাদের মত ঘোরাফেরা করত।
মনে আছে।
আট বছর বয়সে আমার প্রথম নৌকো চড়া।
গঙ্গায় রাধারঘাটের ওপারে গোয়ালজানে আমার ছোট ঠাকুর্দার বাড়ি।
হতকুচ্ছিৎ ভাঙাচোরা নৌকোটায় চড়ে সেখানে গেছিলাম।
দশ বছর বয়সে আন্তর্জেলা স্কুল স্পোর্টসে অংশগ্রহণ করতে গেছিলাম সড়পি।
সেখানে পঞ্চাশ মিটার দৌড়ে সবার পিছনে দৌড় শেষ করার পর বাবার দেওয়া আট আনা পয়সায় তৃপ্তি করে মাখন পাউরুটি খেয়ে বেঁচে যাওয়া পয়সা বাবাকে ফেরত দিয়েছিলাম।
সাংঘাতিক মনে আছে।
চোদ্দ বছর বয়সে আমাদের স্কুলের ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে পনেরই আগস্টের ফ্ল্যাগ তোলার পর দেশাত্মবোধক গান গাইতে গিয়ে মাঝপথে ভুলে গেছিলাম।
আমার সে গান নতুন করে গেয়েছিল আমারই ক্লাসের আরেক জন।
তার নাম ভুলে গেছি।কিন্তু ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের পাশের কদম গাছটার কথা মনে আছে।
ষোল বছর বয়সে টের পাই যে আমার শরীরে ভালো লাগার মন তৈরি হয়েছে।
ঠিক সেই সময়টাতে তিন মাস ধরে ভালো লাগা বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে বাবার সঙ্গে চলে আসতে হয়েছিল অন্যত্র।
গাছের শিকড় ছেঁড়ার মত কষ্ট হয়েছিল হয়তো।
আগের দিন গোটা বিকাল দুজনে এক জামগাছে বসে কাটিয়েছিলাম যে গাছে কেন জানি কোনোদিন জাম হয়নি।
বান্ধবীর মুখটা মনে পড়েনা।কিন্তু গাছের নিচে মুখোমুখি বসে থাকা দুটো গরুর কথা মনে আছে।
আঠারো বছর বয়সে পড়াশোনা করতে কলকাতা চলে আসি।
গ্রাম থেকে ট্রেনে চড়ে শেয়ালদায় নেমে আবাসিক কলেজে আসতে রিকশা বা বাসে চড়তাম না।
মা ভালো জামাপ্যান্ট ও ঘড়ি দিত না সঙ্গে।
কলকাতা খুব খারাপ জায়গা তাই।
ছোট একটা ট্রাংক এক হাতে আংটা ধরে লম্বা করে ঝুলিয়ে নির্বিকার চিত্তে হেঁটে চলে যেতাম এক মাইল দূরের হস্টেলে। একবারও না থেমে।
তারপর রাজধানীর শিক্ষার কল্যানে নিজের ব্যক্তিত্বে মোড়কের পর মোড়ক পড়ল। ছাত্র রাজনীতি শিখলাম।বিপ্লব শিখলাম।কফি হাউস,কলেজ স্কয়ার শিখলাম। আড্ডা শিখলাম।রাত জাগা শিখলাম।
সেসব এখন আর চর্চাতে নেই।
কিন্তু হস্টেলের অত্যন্ত জঘন্য খাবার ও মাসের শেষের গ্র্যান্ডফিস্ট মনে আছে।
পড়ার শেষে হাঁটাচলা করতে পারা আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য লড়াই শুরু হলো।
সে পাক্কা কুড়ি বছরের লড়াই।
সে সব অত মনেও নেই এখন।
কিন্তু কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে পি কে দে সরকারের পুরোনো গ্রামার বই খুঁজে পেয়ে যে আনন্দ হয়েছিল সেটা মনে আছে।
তারপর বিয়ে করলাম।
কষ্টের অভাবের সংসারজীবন যাপন শুরু হলো।
সে কষ্ট কবে ছেড়ে এসেছি!
তবে আটশো টাকা মাসিক ভাড়া বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে কাঁচা আমলকি চিবোতে গিয়ে বউয়ের মুখটা কেমন হতো সেটা মনে আছে।
আমাদের প্রথম বড় বেড়াতে যাওয়া অরুণাচল প্রদেশ।
আমার আটত্রিশ বছর বয়সে।
অরুণাচলে সেবার এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি।
কোনো ল্যান্ডস্লাইড হয়নি রাস্তায়।
তারপর বহু বেড়াতে যাওয়া স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে গেছে সুন্দরী ভার্জিন অরুণাচল।
কিন্তু বমডিলা থেকে তাওয়াং যাবার রাস্তায় খিদের পেটে পাহাড়ি ‘ছোটেন হোটেলে’ ,অসময়ে ‘বাঁধাকপি পাতার ফরাই’ দিয়ে ঠান্ডা ভাত খাওয়া ভুলিনি।
এরপরের জীবন অনেক প্রাপ্তি ও অনেক অপ্রাপ্তির আনন্দ ও হতাশার মিশ্র অনুভূতি।
তারা কোথায় যেন চলে গেছে ফিকে হতে হতে।
জীবনের পথে রেলগাড়ির মতো চলতে চলতে রাস্তার দুপাশে উল্টো দিকে চলে যাওয়া সেসব স্মৃতির ছবি এখন আর মনে থাকেনা অত। মনে রাখতেও চাইনা।
কিন্তু গত একবছর অপ্রাপ্তির খাঁচায় বাস করতে করতে ,সাধারণ ঘটনাগুলোও কেমন যেন স্বপ্ন মনে হয় আজকাল।
#পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়
Dr. Palash Bandopadhyay: A popular doctor, social activist, Post Graduate of Pediatric Nutrition,(Boston University), Author, Poet, and a beautiful mind.
২৪.০৪.২০২১