এক অসামান্য মানবিক গুন্ সম্পন্ন মানুষ রাজীব ধর – প্রাণ বাঁচালেন এক সাংবাদিক বন্ধু রাজীব সরকারের
ভোটের বাজারে মানুষের মানবিকতা যখন তলানিতে ঠিক তখন এক দেবদূতের দেখা পাওয়া গেলো রানাঘাটে । পেশায় সামান্য জলের বোতল বিক্রেতা বাড়িতে স্ত্রী ও অসুস্থ বোন এই নিয়ে অভাবের সংসার । তবুও মেরুদন্ড সোজা, সানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা ।
আশ্চর্য সমাপতন সাংবাদিক রাজীব সরকারের জীবন বিপন্ন হলো রানাঘাট স্টেশনে, প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু ঘাড়ের কাছে থাবা বসিয়ে দিয়েছে তখন, রেল আর স্টেশানের মাঝে পরে গেলেন আর ট্রেন চলেছে চাকায় পা ঘষে যাচ্ছে । ঠিক তখন এক হকার ভাই তার নামও রাজীব, রাজীব ধর নিজের জীবন বিপন্ন করে টেনে তুলেন সাংবাদিক রাজীব সরকার কে ।
অথচ লোকডাউনে জীবন কেটেছে ভিক্ষা করে !!
ঠিক কি ঘটেছিল ২৪ মার্চ ২০২১ রানাঘাট স্টেশনে , শুনুন রাজীব সরকারের নিজের বয়ানে ।
আমার জীবনদাতা: আজ আমার পুনর্জন্ম।
আজ কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার পথে Mrityunjoy Chakraborty এর সঙ্গে দেখা করার জন্যে “রানাঘাট স্টেশনে” নেমে ওর অফিসে গিয়ে দেখা করে, দুপুর ১-টা ২০ মিনিটের “লালগোলা – শিয়ালদহ ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার” ট্রেন ধরার জন্যে রানাঘাট স্টেশনে ঢুকতে গিয়ে দেখি ট্রেন ছাড়ছে।
পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত নানান সমস্যায় মানসিকভাবে ভেঙে থাকায় আমি কিছুটা “আউট অফ মাইন্ড” ছিলাম। তবুও দৌড়ে সেই ট্রেন ধরতে গিয়ে ভুল করে আমি “রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে” (Reservation Compartment : S-3, Coach no. ER 10212) উঠে পড়তেই, যাত্রীরা হইহই করে ওঠে। আমিও “আউট অফ মাইন্ড” থাকায় কিছু বুঝতে না পেরে কিছু বড় ভুল কিছু করেছি ভেবে ট্রেনে উঠেই আবার ট্রেন থেকে নামতে যাই। কিন্তু খেয়াল করিনি ট্রেনের স্পীড বেড়ে গেছে। ফলে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে আমার পা স্লীপ করে “চলন্ত ট্রেন” এবং “প্ল্যাটফর্মের” মাঝে শরীর ঢুকে যায়।
ওদিকে ট্রেনের ভিতরের এবং প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা চিৎকার করছে — “দাদা! ধরুন….!!! ধরুন…!!! কিন্তু ধরবে কে?
কেবলমাত্র আমার “বাঁ হাত” তখনও কামরার হাতল ধরে রয়েছে। আমার শরীর নীচের দিকে ক্রমাগত টানছে, অন্যদিকে ফার্ষ্ট প্যাসেঞ্জার হাই স্পীডে ছুটে চলেছে। আমার ডান পা চাকার সঙ্গে ঘষা খাচ্ছে, সেই ঘর্ষণে আমার জুতো খুলে পড়ে গেছে। আমি অনুভব করছি আমার পা চাকায় জড়িয়ে যাবে এবং আমি নীচে পড়ে যাব এবং আমার মৃত্যু নিশ্চিত তা নিজের চোখে আমি দেখতে পাচ্ছি। ট্রেন থেকে পড়ে চাকায় জড়িয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ করে #দেবদূতের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে এক ব্যক্তি। প্রাণপণে সে আমাকে কামরার ভিতর টেনে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। কেউ আমাকে টানছে বুঝতে পেরে আমি হাত দিয়ে ধরে রাখা ট্রেনের দরজার হাতলটায় টেনে শরীরটা উপরে তোলার একটু চেষ্টা করতেই, পিছনে আমাকে ধরে রাখা সেই ব্যক্তি টেনে কামরার ভিতরে ঢুকিয়ে নেন এবং কামরার ভিতরে আমায় নিয়ে উল্টে পড়েন।।
ভাগ্যভাল ছিল যে লাইনে কোন সিগন্যাল পোষ্ট বা অন্যকোন পোষ্ট ছিল না। না হলে হাইস্পীডে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যু অবধারিত ছিল।
কামরার ভিতরে থাকা “টিটি” এবং অন্যরা ধরে সিটে বসান। জল খাওয়ান।
একটু ধাতস্থ হয়ে আমার জীবন বাঁচানো মানুষটিকে দুচোখ ভরে দেখলাম। ট্রেনের কামরায় জল বিক্রি করা এক হকার। গায়ে কালচে নীল গেঞ্জী, কাঁধে আকাশী রঙের টাওয়েল। নোংরা প্যান্ট।। কি বলব আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। তবু একবার বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ বাদে আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। নাম #রাজীবধর ওরফে #রাজাধর। দেবতার দূত হয়ে আসা #হকার মানুষটির ফোন নাম্বার – 9647514181
তবে এটা ধ্রুব সত্য হকার ছাড়া সাধারণ কোন যাত্রী ওই জায়গায় থাকলে, আমি আজ লাশকাটা ঘরে শুয়ে থাকতাম।
আমরা অনেকেই ট্রেনের হকারদের অপচ্ছন্দ করি, ঘৃণাও করি। কিন্তু ভারতবর্ষের সমগ্র রেল পরিসেবায় এই অচেনা অজানা হকার মানুষগুলোই প্রকৃত বন্ধু। এদের সম্মান করলে আমরাই এরকম বা অন্যরকম বিপদে উপকৃত হব।
আরেকটা কথা না বললে নয়। মানুষ “নিয়তির ডাক” কথাটা অনেকে খুব বলেন। এটা যে কত সত্য আজ মৃত্যুমুখ থেকে না ফিরলে জানতাম না। এ অভিজ্ঞতার কথা থাক।
যারা আমাকে ভালবাসেন, যারা আমার প্রতি সত্যিই মনে ঘৃণা পুষে রাখেন না, কেবলমাত্র তারা যদি পারেন আজকে আমার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে প্রাণ বাঁচানো #হিরো মানুষটাকে ধন্যবাদ জানাবেন। আমাকে আজ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কোনও মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।।
উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলো শিক্ষার অহংঙ্কারে থেকেও অন্য মানুষদের ঠকিয়ে, মিথ্যাচারিতায়, প্রবঞ্চনায় রাঙিয়ে নিজের নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু এদের মতো “ছোট মানুষগুলো “ছোট বোতল ১০ টাকা, আর বড় বোতল ২০ টাকায় বিক্রি করে কষ্টে সংসার চালিয়ে নিজের জীবনকে বাজি রেখে অন্যের জীবন বাঁচায়। এরাই সমাজের প্রকৃত হিরো।
দেবতার দূত হয়ে আসা #হকার সেই মানুষটির ফোন নাম্বার – 9647514181। রানাঘাটেই কোথাও বাড়ি।
আমার প্রচন্ড আঘাত লেগেছে বুকের বাঁদিকে। অস্বাভাবিক যন্ত্রণা। ডানহাতের সামান্য নখ উপড়ে গেছে। ডান পা জখম। কিন্তু এক কণাও #রক্তপাত ঘটেনি।
তবে দমদম স্টেশনের প্লাটফর্মে নেমে একটা জায়গায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ভেবে দেখলাম — “কেন জানিনা মনে হল “হয়ত আমার #মৃত্যুটা সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল”।।
Photo and News Source : রাজীব সরকার,রানাঘাট ,২৪-শে মার্চ’ ২০২১