জীবনের মুহূর্ত কাটিয়ে ফিরেছে জীবন… লক ডাউন কে আনলক করে প্রতিশ্রুতি আর কথকের হাত ধরে শিল্পীর সিঁড়ি উঠে গ্যাছে তিন তলায়.. এস্রাজ এর ছড়ে গমগম করছে ছাদ, পলেস্তারা আর আকাশের শামিয়ানা..
কুড়ির পর একুশে এসে মুখোমুখি
পুষ্পেন্দু চ্যাটার্জির.. আবেগ ও উত্তেজনা আগের থেকে আরও নিভৃত হয়েছে.. শান্ত আর ধীর ভাব এই শিল্পীর লক্ষণ . আগুনের দাউ দাউ যার মধ্যে বাঁচে তাকে আলাদা করে দেশলাই জ্বালাতে হয় না.. অবাকই হলাম… নিজেকে আবিষ্কারের এক অদ্ভূত মায়া দেখলাম শিল্পীর মুখে… এটা ভাসানের নয়, সূর্যোদয়ের আলো…
এগোলো কথা কথায় হাত ধরেই…
1প্রশ্ন :প্রায়ই সমস্ত ব্যান্ড ভাঙছে.. এর ব্যান্ডমেম্বারা অন্য ব্যান্ডমেম্বারদের ছোট করছে..তাদের উদেশ্যে কি বলবে?
পুষ্পেন্দু :আমাদের মজ্জায় একে অপরকে ছোট করা ঢুকে গ্যাছে…আমরা সিনিয়র জুনিয়র জ্ঞান করি না.. আর এটা সিনিয়রদের মধ্যে একটা জুনিয়রদের প্রতি বর্ণবৈষম্যের মতো রূপ কাজ করছে….আমি এখনও আমার বাড়ির গুরুজনদের কথা মাথা নত করেই আমি শুনি.. আসলে বার বারই আমার মনে হয়েছে শিক্ষা শুরু হয় ঘর থেকে.. ওটাই আপনার আঁধার, ভাঁড়ার.. আসলে শাসনের পর যে আদরটা দরকার সেটা আমরা ভুলেই গেছি… আসলে আন্তরিকতা টাই মিসিং.. ছোটরাও বড়দের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গাটা হারিয়েছে.. আসলে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মতো একা একা বাঁচার অভ্যেসে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি.. একসাথে বড় হওয়ার কালচার টাই আমাদের নষ্ট হয়ে গ্যাছে… সেক্রিফাইস বা স্বার্থত্যাগ হারিয়েছি আমরা.. ফলে বিভক্ত আমরা… ব্যান্ড ভাঙছে একদিকে ভালো ও খারাপ দুটোই হচ্ছে.. কেউ মিউজিক্যাল কারণে ভাঙছে কেউ ননমিউজিক্যাল কারণে ভাঙছে…মিউজিক্যালি রিচ করতে না পারলে ব্যান্ড ভাঙাটা গ্রহণীয় কিন্তু অন্য কারণে ভাঙাটা কষ্ট দায়ক… যেমন আমি হাফ মেজর বন্ধ করে দিয়েছিলাম কেননা মনে হয়েছিল আমি এখনও প্রিপিয়ার্ড নই.. এটা একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম.. এই সাহসের জন্য আমি গর্ব বোধ করি.. নিজের ব্যান্ড বন্ধ করে দেয়া মানে নিজের সন্তান কে হত্যা করার মতো ব্যাপার..যেদিন দায়িত্ব নিতে পেরেছি সন্তানের সেদিন আবার ফিরেছি… এবং হাফ মেজর আপনাদের সামনে দার করাতে পেরেছি
‘জুনিয়র” এই শব্দটা আমার কাছে খুবই আপত্তিজনক একটা শব্দ। সিনিয়র , “জুনিয়র” এটা শুনলেই কেমন যেনো গা জ্বলে যায়,মনে হয় দাবা খেলার মতো ব্যাপার। মানে ধরো আমি রাজা, তুমি মন্ত্রী,আর বাকি সব বোড়ে, এরম একটা বৈষম্মতা। মিউজিক করতে এসে যদি ঐ সেই একই রকম পাসা খেলা চলে তাহলে মুস্কিল। আসলে আমি বুড়ো আর তুমি কচি, এটা সোজা গদ্য। আমি আমার থেকে কোনো বয়েসে কম ছাত্র বা ছাত্রীকে কে কোনো দিন আমায় সিনিয়র বলতে সেখাইনা। আমি দাদা এটাই আমার পরিচয় ।
আমি প্রণামে বিশ্বাসী নই, আমি তাকেই প্রণাম করি যাকে আমার প্রণাম যোগ্য মানুষ বলে মনে হয়। আমি আমার ৮ বছর বয়স থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রোজ সকালে আহ্নিক করি,একদিনও ব্যতিক্রম হয়না, তাহলে বুঝতে পারছো আমি ধার্মিক এবং গোঁড়া। কিন্তু সেই আমি একজন এমন মানুষ যে ধর্মান্ধ নয়। ছোট বয়েষে একবার মামাবাড়ীতে জাতপাত ভুলে একজন জমাদার কে প্রণাম করেছিলাম, সে ব্যক্তিটি খুব অপ্রস্তুত হয়ে ছিলেন,এই ঘটনাটি ঘটেছিলো একটা বিশেষ অবস্থাতে, কারণ আমার তাকে প্রণাম করতে ইচ্ছা হয়ে ছিল তার একটি বিশেষ কাজের জন্য, অথচ এই আমি আমার বাড়িতে পুরোহিত পুজো করতে এলে সারা বাড়ির লোক প্রণাম করলেও আমি করিনা কারণ আমার মনে হয় সে এমন কিছু করেনি যাতে তার কাছে মাথা নিচু করা যায়। তাই ভক্তি থাকুক মনের অন্তরে, সেটা জহির করতে কোনো লৌকিকতা প্রামাণ্য হতে পারেনা। আমার মনে হয় প্রতিটা মানুষ এক একটি মন্দির আর একজন প্রকৃত মানুষের মধ্যেই আসল ভগবান অধিষ্ঠান করেন, তাই আমি সেই মন্দিরে মাথানত করি যে মন্দিরে আমি ভগবানকে খুঁজে পাই।
তাই আমার মনে হয় “সিনিয়দের” (তোমাদের কথায়) যোগ্য সন্মান জ্ঞাপন করতে সত্যি যদি কোনো “জুনিওর” ( চারা পোনা) কে সত্যিকারের ভালোবাসা সন্মান দেখাতে হয় সেটা তার মনে মনে থাকা ভালো, লোক দেখিয়ে ফেইসবুকে চদ্দিখানিক ছবি পোস্ট করে কিস্যু প্রমাণ হয়না। সত্যিকারের ভালোবাসা জাহির করার প্রয়োজন পড়েকি? আমার বাবা বা মা, কিম্বা তোমার স্ত্রী রোজ “কত ভালোবাসি , কত ভালোবাসি “বলে ছবি পোস্ট করে কি?
নাহ তারা নাহ আমরা কেউ এমন কাজ করিনা,কারণ আমাদের প্রয়োজন পড়েনা, কারণ এটা লোক দেখানো নয়, চিরন্তন। ঠিক তেমনি যারা নতুন কাজ করছে তারা সেল্ফি, ক্যামেরা, অমুক দাদা, তমুক দাদা, ওই দিদি এদের সাথে যত ছবির হিড়িক কমাবে ততই তাদের ক্যারিয়ার এর সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে বলে আমি মনে করি।
আমি নানা মানুষের সাথে কাজ করেছি, আগামীতেও করবো,আমায় চট করে বধ করা মুস্কিল সেটা সবাই জানে,বোঝে তাই লাগতে আসেও কম। তবে এই ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক ভালো মানুষ আছেন,অনেক বাজে মানুষ আছেন, আর আছে অনেক গুলো মুখোশ।
এই ভালো আর খারাপ যারা তারা আসলে যে নতুন কাজ করছে তার জন্য শুভ, কারণ তারা সৎ,তাদের তুমি চিনে যাবে প্রথমেই ,কিন্তু কিছু মুখোশ আছে যারা তোমায় এত পরিমাণে গ্লুকন্ডি খাওয়াবে, এত এত পাম্প করবে তুমি কবে যে আইসক্রিম চাটা ছেড়ে দিয়ে সেই ব্যাক্তির পা চাটতে শুরু করেছ সেটা বুঝে উঠতে উঠতে দেখবে সব শেষ। কবে তোমার দাদাটি তোমার গুরু হয়ে যাবে, তারপর তোমার মাথা চিবিয়ে খেয়ে ছিব্রে করে ফেলে দেবে বুঝতে পারবেনা। কারণ তোমার চোখে তখন তোমার পরম পিতা,আর তুমি তার পশ্যপূত্র।
বন্ধু বা গড ফাদার ভালো যদি তোমার সাথে তার সম্পর্কও হয় নিঃসার্থ তবেই মঙ্গল। আর তুমি যদি নিজের কোনো আখের গোছাতে এরম গড ফাদার বানাও তাহলে এটা জেনে রাখো তুমি শিশু,সে একজন পোড় খাওয়া মানুষ,তোমার চাটুলতা বুঝতে তার প্রথম দিনটাই যথেষ্ট।
তাই তাকে পরে দোষারোপ করার আগে জেনে রাখো তুমি দোষী। তোমার সার্থ ছিল হয় তার মিউজিক এর সফলতার ফর্মুলা,বা শর্টকাট খুঁজে পাওয়া, কিম্বা অমুক দাদার তমুক দাদার লেজ হয়ে পিছনে ব্যাগ বয়ে বেড়ানো। একজন মিউজিক করে বড় হবো এরম স্বপ্নে বুঁদ যে ছেলেটি একদিন একটা বড়ো স্টেজের স্বপ্ন দেখেছিল সে যখন কারুর ব্যাগ বয়ে নিয়ে যায় সেদিন বুঝতে হবে তার অন্তরের মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। আর এর জন্য যে করেছে সে যতটা দায়ী ঠিক ততটা ওই সদ্য মিউজিকে আসা ছেলেটি বা মে টিও দায়ী। এর কারণ একটাই দুই তরফ থেকেই সার্থ ছিল।
মিউজিক একটা জার্নি, যেখানে তুমি একা, কেউ ছিলনা তোমার সাথে, তুমি নিজে যন্ত্র কিনে , শিক্ষক নির্বাচন করে তোমার লড়াই শুরু করে ছিলে,তাই তোমার পিছুটান, লাভ ক্ষতি, চালাকি এগুলো দূরে সরিয়ে সামনে এগোলে সাফল্য আসবে , হোক না একটু সময় লাগলো।
আমরা আজকাল খুব অস্থির, দ্রুত সফলতা পাওয়ার চেষ্টা করি,কেউ ধৈর্য ধরতে চাইনা।
শেষে একটা কথা বলবো বাবা ,আর মা এই দুই মানুষ একমাত্র গুরু এরা ছাড়া বাকি সবাই কোনো নাহ কোনো সার্থ নিয়ে চলছে, যদি পথ খুঁজে না পাও অবশ্যই তাদের কাছে বসো সব বলো পথ বেরোবে। এই দুই মানুষ ছাড়া এই পৃথিবীতে সবাই কে বিশ্বাস করো তবে অন্ধবিশ্বাস কোরো না।
2.প্রশ্ন :আর কি কি শেখার ইচ্ছে আছে?
পুষ্পেন্দু : আপাততঃ রেকর্ডিং আর কীবোর্ড শেখার ইচ্ছে আছে.. আর মিউজিক ছাড়া রাজনীতি করার ইচ্ছে আছে..
3.প্রশ্ন :গসিপে না সাধনায় নিজেকে রাখতে চাও?
পুষ্পেন্দু : আমি সাধনাতেই থাকতে চাই কেননা সাধনাই সম্পদ.. গসিপ করবো না বাঙালী হয়ে এটা কোনো দিন হতে পারে? আমি গসিপ করি এবং ফাটিয়ে করি.. বিরিয়ানি র পরে ফিরনি আর কাজের পর গসিপ এটার মজাই আলাদা
4.প্রশ্ন :সেরা কাজ কোনটা?
পুষ্পেন্দু : এখনও সেরা কাজ করে উঠতে পারিনি তবে আসবে.. লোকে বলে শ্রেণীশত্রু আমার সেরা কাজ.. আমার সেটা মনে হয় না.. তবে এই বছরই সেরাটা আসতে চলেছে মনে হয়
5.প্রশ্ন :জেগে কোন স্বপ্ন দেখো?
পুষ্পেন্দু : জেগে আমি সব স্বপ্নই দেখি.. আমি একজন ড্রিমার.. আমার আজ যা বাস্তব একদিন এগুলোই আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম.. আমি যে আজ মাষ্টারডিগ্রি করেছি, এই যে WBCS পড়েছি, আমি আজ সরকারি চাকরি ছেড়ে মিউজিক করছি এগুলো সবই আমার স্বপ্ন কে বাস্তবে পরিণত করেছি..আমি পাঁচহাজার দর্শকের সামনে বাজিয়েছি স্টেজ করেছি.. সবই আমার স্বপ্ন ছিলো কিন্তু বাস্তবে হয়েছে.. একজন মিউজিসিয়ানের স্বপ্ন কানেক্ট করা সেটা আমি বোধয় আমার শ্রোতা ও দর্শকের সাথে করতে পেরেছি..
6.প্রশ্ন :মিউজিসিয়ান পুষ্পেন্দু মানুষ পুষ্পেন্দু কে কতো নম্বর দেবে?
পুষ্পেন্দু : মিউজিসিয়ান পুষ্পেন্দু মানুষ পুষ্পেন্দু কে একশোয় একশো নাম্বার দেবে..কারন, আমার জন্য যেনো কারোর কোনো ক্ষতি না হয়ে যায় এবং দুই যাতে আমার থেকে আমার ছায়া যাতে বড় না হয়ে যায়.. মাটিতে পা রেখে চলা টা মানুষের লক্ষণ এবং ঔদ্ধত্ব বর্জন করাটা শিল্পীর লক্ষন হওয়া উচিৎ
(চলবে )
মুখোমুখি আলোচনায় @অভিজিৎ পাল