আবারো গণতন্ত্র হারাল মিয়ানমার
নব ঠাকুরীয়া
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আরো একটি সুযোগ হারাল মিয়ানমার (আগে বার্মা হিসেবে পরিচিত ছিল)। গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে নতুন পার্লামেন্ট শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই দেশটির সেনাবাহিনী তাতমাদাও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ক্ষমতা দখলে নেয়।
সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা মিয়াওয়াদি টেলিভিশন চ্যানেলে সেদিন সকালে ঘোষণা করা হয় যে, মিয়ানমারে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়ে হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়ন্ত সোয়ে (একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ সেনাপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করেছেন এবং ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।
ইয়াঙ্গুনের স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান অং সান সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ত, স্টেট চিফ মিনিস্টার ফিও মিন থেইন, জ মিন্ত মং, অং ম নিম, দ নান খিন, হতে মিন্ত ও নি পুসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাসভবন থেকে আটক করা হয়েছে। কয়েকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানের গণতন্ত্রপন্থী এবং মানবাধিকার অনেক অ্যাক্টিভিস্টকে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে।
১ ফেব্রুয়ারির সকাল থেকেই মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় রেডিও ও টিভি (এমআরটিভি) ঘোষণা দেয় যে, সকাল থেকে কোনো অনুষ্ঠান চলবে না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সশস্ত্র সেনা মোতায়েন করা হয়। সময়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন স্থগিত করে দেয়া হয় এবং নেপিডোর পথঘাট ফাঁকা হয়ে যায়।
২০২০ সালের ৮ নভেম্বর বহুদলীয় নির্বাচনের পরিণতি থেকেই মিয়ানমারে বিরোধের জন্ম হয়। এই নির্বাচনে এনএলডি-সমর্থিত প্রার্থীরা বড় সাফল্যের মুখ দেখে। বিপরীতে সেনা-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়। ২০০৮ সালের সেনাবাহিনী প্রণীত সংবিধানের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও দলটি ৪৭৬ আসনের মধ্যে মাত্র ৩৩টি আসনে জয় লাভ করে।
অন্যদিকে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি’র নেতৃত্বাধীন এনএলডি পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন মিলিয়ে মোট ৩৯৬টি আসন জেতে। বার্মিজ স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা জেনারেল অং সান কন্যা সু চি ২০১৫ সালের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পান। এর আগে তিনি প্রায় এক দশক ধরে সামরিক জান্তা কর্তৃক গৃহবন্দী ছিলেন।
নির্বাচনের পর থেকেই সেনা কর্তৃপক্ষ (ইউএসডিপির মাধ্যমে) অনবরত এনএলডির নেতৃত্বাধীন সরকারকে ভোট কারচুপিতে অভিযুক্ত করে আসছে। দেশটির নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। যদিও দেশটিতে এই প্রতিষ্ঠানের খুব বেশি প্রভাব নেই, তবু ইউএসডিপি সুপ্রিম কোর্টে একটি অভিযোগ দায়ের করে।
লন্ডনভিত্তিক বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, নির্বাচনে কারচুপিকে সমর্থনের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই এবং গত কয়েক দিন ধরেই পরিস্থিতি দ্রুত ঘনীভূত হচ্ছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, সেনাবাহিনী কী পদক্ষেপ নেবে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। গত ১০ বছর আগে থেকেই তারা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, যার সুবিধা তারা পাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারের সেনা প্রধান মিন অং হ্লেয়িং সম্প্রতি বলেন যে, দেশের ঐক্য সুরক্ষার জন্য সংবিধান সংশোধন করা জরুরি। এই সংবিধান অনুযায়ী কেবল প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর সে ক্ষমতা নেই। সেনা মুখপাত্র জ মিন তুন ঘোষণা দেন যে, পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা আইন প্রয়োগ করবেন।
এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের জন্য শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। ১৯৪৮ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কয়েকবার দেশটি সামরিক অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৬২ ও ১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থান। মিয়ানমারের সেনাদের এটা বোঝানো জরুরি যে, তাদের ভাবনায় বড় ধরনের ভুল রয়েছে।
২০১৭ সালে রাখাইন (আরাকান) রাজ্য থেকে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত করার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অং সান সু চির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার পরও তিনি মিয়ানমারের প্রভাবশালী রাজনীতিক হওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নতুন সংবিধান অনুযায়ী সু চি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি, কেননা তার স্বামী একজন বিদেশি নাগরিক। এখন পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হচ্ছেন, কেননা সেনাবাহিনী কাউন্টার টেররিজম অপারেশনের নামে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে।
এনএলডি জোটের একজন কর্মী লেখকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, অনেকেই নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না। তারা সম্ভবত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অথবা তাতমাদাও জেনারেলের কট্টর সমর্থক। ট্রাম্প সমর্থকরা ওয়াশিংটনে নতুন সরকারকে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছেন, কেননা সেখানে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত। কিন্তু মিয়ানমারে গণতন্ত্র নামমাত্র। এ কারণেই সেনা জেনারেল জয়ী হয়েছেন। আরো কয়েক বছরের জন্য মিয়ানমার অন্ধকারে চলে যাবে।
মিয়ানমারে আপাত সামরিক অভ্যুত্থান এবং বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টিতে বার্মাকেন্দ্রিক অনেক সংস্থা নিন্দা জানিয়েছে। প্রগ্রেসিভ ভয়েস, আল্টসিন-বার্মা এবং ওমেনস পিস নেটওয়ার্কসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা বলছে, সেনাবাহিনী যাদের নির্বিচারে আটক করেছে তাদের শীঘ্রই মুক্তি দেয়া এবং পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সব দলকে পার্লামেন্টে নিয়ে এসে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক।
সংস্থাগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে আবেদন জানিয়েছে, যাতে মিয়ানমারের অবস্থা পর্যবেক্ষণে প্রতিনিধি পাঠানোপূর্বক জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে বিষয়টিতে দ্রুত সাড়া দেয়। এ ছাড়া সংস্থাগুলো আবেদন জানিয়েছে, যাতে করে সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্কে শর্তারোপ করা হয় এবং বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়।