ভারত সরকার কোনোদিনই সরকারীভাবে গান্ধীজীকে ‘জাতির জনক’ রূপে আখ্যায়িত করেনি
হীরক মুখোপাধ্যায় (২ অক্টোবর ‘২০):- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-র ১৫২ তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে এই কথা স্পষ্টভাবে জেনে নেওয়া ভালো, ভারত সরকার গান্ধীজীকে কোনোদিনই সরকারীভাবে ‘জাতির জনক’ রূপে আখ্যায়িত করেনি।
১৯৪৪ সালের ৬ জুলাই সিঙ্গাপুর বেতারের এক অনুষ্ঠানে মৌখিকভাবে প্রথমবার গান্ধীকে ‘ফাদার অব দ্য নেশন’ বা জাতির জনক বলে উল্লেখ করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস।
তবে এই কথা মাথায় রাখতে হবে ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী অধিবেশন থেকে জাতীয় কংগ্রেস-এর সর্বভারতীয় সভাপতি রূপে নির্বাচিত হওয়ার পরেও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যেভাবে নিজের ও জওহরলাল নেহরুর স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সুভাষচন্দ্র-কে জাতীয় কংগ্রেস-এর সর্বভারতীয় সভাপতির পদ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন, সেই কথাকে স্মরণে রেখে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-কে ‘জাতির জনক’ বলে বেতারের মাধ্যমে পরিহাস করেছিলেন,যদিও সে কথা বিতর্কের অবকাশ রাখে ।
যদিও নেতাজী-র ব্যাঙ্গ মিশ্রিত এই সূক্ষ্ম পরিহাসকে ধরতে না পেরে সরোজিনী নাইডু ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল কংগ্রেসের এক অধিবেশনে গান্ধীকে ‘জাতির জনক’ বলে দ্বিতীয়বার আখ্যায়িত করেন।
গান্ধী যাঁকে জাতীয় কংগ্রেস-এর সর্বভারতীয় সভাপতির পদ থেকে সরে যেতে ও দল ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন সেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস এবং সরোজিনী নাইডু প্রকাশ্যে গান্ধীকে ‘জাতির জনক’ রূপে উল্লেখ করার পর গান্ধীর মৃত্যুর পর ১৯৪৮ সালে ভারতীয় বেতার-এর এক বার্তায় তৎকালীন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু গান্ধী-কে পুনরায় ‘জাতির জনক’ রূপে আখ্যায়িত করেন।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-কে ‘জাতির জনক’ রূপে আখ্যায়িত করার এটাই চরম ইতিহাস। গোদা বাংলায় সবই কথার কথা।
না তো ভারত সরকার, না তো ভারতীয় সংসদ বা দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি-র কার্যালয়, কেউই কোনোদিনই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-কে সরকারীভাবে ‘জাতির জনক’ রূপে স্বীকৃতি দেয়নি।
সরকার যখন গান্ধীকে ‘জাতির জনক’ রূপে পাকাপোক্ত কোনো স্বীকৃতি দেয়নি তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ভারতের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে কেনো শেখানো হবে ভারতের ‘রাষ্ট্রপিতা’ বা ‘জাতির জনক’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ?
এর সম্ভাব্য উত্তর একটাই, সরকারীভাবে গান্ধীজীকে ‘রাষ্ট্রপিতা’-র স্বীকৃতি দিতে না পেরে জওহরলাল নেহরু জাতীয় কংগ্রেস-এর অনুসারী একশ্রেণীর পদলেহনকারী শিক্ষাবিদদের মাধ্যমে সমস্ত দেশে এই ভুল তথ্য পরিবেশনে বাধ্য করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতেই স্বাধীন ভারতের ছাত্রছাত্রীরা একেবারে শৈশব থেকেই এক মিথ্যা তথ্য শুনতে, শিখতে, বলতে ও লিখতে বাধ্য হচ্ছে। আরটিআই প্রশ্নের মাধ্যমে এলেখা প্রকাশ প্রজন্ত ইহা সর্বৈব সত্য ।
এই বিষয়েও একটা মজাদার সত্য ঘটনা জেনে রাখা ভালো, আজ থেকে মাত্র ৮ বছর আগে ২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ঐশ্বর্য্য পরাশর (১০) তার ‘সোশ্যাল স্টাডিস’ পাঠ্যপুস্তক পড়তে পড়তে কতগুলো প্রশ্ন তার মায়ের কাছে করে- “মা গান্ধী-কে কেন জাতির জনক বলে ?” মা উর্বশী শর্মা চুপ করেছিলেন তাঁর কাছেও মেয়েকে বলার মতো এ বিষয়ে কোনো উত্তর ছিল না।
কয়েকদিন পরে উর্বশী দেবী মেয়ে ঐশ্বর্য্য কে বলেন আরটিআই করে এই বিষয়ে তথ্য জানতে চাইব।
সিদ্ধান্ত মতো তাঁরা দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর দপ্তরে ‘তথ্য জানার অধিকার আইন ২০০৫’ অনুযায়ী এই সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশন করার অনুরোধ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সেই চিঠি ফরোয়ার্ড হয়ে চলে যায় ‘মিনিস্ট্রী অফ হোম অ্যাফেয়ার্স’ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে। ভারত সরকারের ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক’ তাদের মন্ত্রকের আভ্যন্তরীণ প্রামাণ্য দলিল দস্তাবেজ বারবার ঘেঁটেও কোন তথ্য উদ্ধার করতে না পেরে তাঁরা আবেদনপত্রটা ফরোয়ার্ড করে দেয় ‘ন্যাশনাল আর্কাইভস্ অফ ইন্ডিয়া’ দপ্তরে।
কিছুদিন বাদে ‘ন্যাশনাল আর্কাইভের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর তথা ‘সেন্ট্রাল পাবলিক অফিসার’ জয়প্রভা রবীন্দ্রন ষষ্ঠশ্রেণীর পড়ুয়া ঐশ্বর্য্য-কে লিখিত আকারে জানিয়েছিলেন, “আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই যা এই বিষয়ে যথাযথ কোনো কারণ দেখাতে পারে। তুমি চাইলে নিজে এসে ন্যাশনাল আর্কাইভের রেকর্ড খতিয়ে দেখতে পারো, তোমার আগ্রহকে আমি স্বাগত জানাই।
আমরা কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য পেলে তোমাকে অবশ্যই জানাবো।”
সরকারী তরফ থেকে এরকম স্পষ্ট বিবৃতি আসার ফলে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ঐশ্বর্য্যর মা উর্বশী দেবী।
তবে মজার কথা এখানেই শেষ নয় এই বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে উত্তরপ্রদেশ-এর হাথরসের বাসিন্দা গৌরব অগরওয়াল ‘তথ্য জানার অধিকার আইন ২০০৫’ অনুসারে একই প্রশ্ন তুলে জানতে চান, “মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কী সত্যি রাষ্ট্রপিতা ?
কোন সালে, ভারত সরকার তাঁকে এই স্বীকৃতি দেন ?”
এর উত্তরে আগরওয়ালকে জানানো হয়েছে, “আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই যে উনি রাষ্ট্রপিতা।”
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-কে যদি ‘জাতির জনক’ বা ‘রাষ্ট্রপিতা’ আখ্যা দেওয়া হয় তাহলে ডাঃ ভীমরাও আহমেদকর-কে কেনো ‘ভারতীয় সংবিধানের জনক’ রূপে আখ্যায়িত করা হবেনা!
এই শীর্ষক এক আবদার নিয়ে ২০০৪ সালে একবার দাবী তুলেছিলেন দিল্লীর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত।
সেই সময় ভারতের উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানি শীলা দীক্ষিত কে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন, “ডঃ আম্বেদকর-কে সাংবিধানিক ভাবে ‘ভারতীয় সংবিধানের জনক’ আখ্যা দেওয়া অসম্ভব। কারণ ওঁনার রচিত সংবিধানেরই ১৮ (১) অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা আছে- ‘সামরিক ও শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্র কাউকে এই সম্পর্কিত কোনো উপাধি দিতে পারবে না’।” আম্বেদকর জি কি জেনে বুঝে এই ধারা রেখে দিয়েছিলেন যাতে গান্ধী ও তার পোষ্য নেতারা দেশের সম্মান কে অযোগ্যের (?) হাতে তুলে দিতে না পারেন?
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সংবিধানে লেখা এই আইনের গেরোতে পরেই জওহরলাল নেহরু গান্ধী-কে ‘রাষ্ট্রপিতা’ বা ‘জাতির জনক’-রূপে সরকারী স্বীকৃতি দিতে পারেনি।
সম্প্রতি দেশের শীর্ষ আদালতের খণ্ডপীঠ (প্রধান বিচারপতি এস.এ.বোব্দে বিচারপতি বি.আর গাওয়াই ও সুয্যকান্ত) এক শুনানীর শেষে গভীর পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন “কোনো রকম সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছাড়াই জনগণ গান্ধীজীকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে” ।
ব্যক্তিগত ভাবে সুভাষচন্দ্র কে যারা ভালোবাসেন বা যারা ভগৎ সিং , মাস্টার দা , বিনয় বাদল দীনেশ বা উধাম শিং কি সাভারকার কে পছন্দ করেন সেই জনসংখ্যার কতজন এই সীকৃতি দিয়েছেন বলা শক্ত । কিন্তু গান্ধীবাদীদের কাছে তিনিই জাতির পিতা ।
গান্ধীর জন্মতিথিতে তাই স্বার্থকভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠছে , আর কতদিন ভারতের জনগণ ও ছাত্রছাত্রী গান্ধী সম্পর্কে এই মিথ্যা তথ্য ধারণ করবেন ?
গান্ধীজীকে যখন সরকারীভাবে ‘রাষ্ট্রপিতা’-র স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, বা দেয়া যায় না তাহলে কেনো ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের মিথ্যা তথ্য শিখতে হবে ?, গান্ধীজী নিজেই যখন বলে গেছেন, ‘বুরী বাত ন বোলো, বুরা কাম ন করো, বুরা চিজ ন দেখো’ তখন গান্ধী সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরী করা কী বুরী বাত শিখানে কী কোশিস নহী হ্যায়। এইভাবে সত্যি কী কাউকে সম্মান জানানো যায়!
গান্ধী ও তাঁর ঐতিহাসিক প্রভাব সত্যের নিরীখে তুলে ধরলে , ওই মহান ব্যক্তির আদর্শকেই সামনে রেখে সত্যমেব জয়তে বলা যাবে। কলোনিয়াল হ্যাংওভার আর কোনটা ঠিক কোনটা ভুল জানা অনেক জরুরী । কোনো রং না মেখে সত্যের আলোকে ইতিহাস কে জানা জরুরী , আপনাদের কি মত ?