“কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতার মানে আমরা সত্যিই বুঝি না বা বুঝতে চাই না,যেগুলো গোষ্ঠী বা জাতির স্বার্থে বোঝার সময় কিন্তু পেরিয়ে গেছে।”
ড: পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা , ১৫ অগাস্ট ২০২০
আজ তিয়াত্তর বছর শেষ হলো আমরা জাতি হিসাবে পরাধীন থেকে স্বাধীন হয়েছি।যদিও মননে,চেতনায়,শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমরা অনেকেই এখনো স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধায় লালন করার থেকে তার অপব্যবহারই বেশি করি।আমাদের স্বাধীনতা ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের সংবেদনশীলতাকে আঘাত করে,আমাদের নিষ্ঠুর,দায়িত্বজ্ঞানহীন,স্বার্থপর করে।আমাদের লাগাম ছাড়া স্বাধীনতার আস্ফালন অন্য অনেকের স্বাধীনতার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাদের জীবনকে অসহায় ও বিষময় করে তোলে।
প্রতিটি স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তাই গর্বিত হওয়ার,আনন্দ করার পাশাপাশি আমাদের এখন আত্মসমালোচনাও দরকারি ও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতার মানে আমরা সত্যিই বুঝি না বা বুঝতে চাই না,যেগুলো গোষ্ঠী বা জাতির স্বার্থে বোঝার সময় কিন্তু পেরিয়ে গেছে।
স্বাধীনতা মানে কিন্তু সামনে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এমন পরীক্ষার্থীর বাড়ির সামনে অথবা মুমূর্ষু রোগীর বাড়ির সামনে মাইকে তারস্বরে দেশাত্মবোধক গান বাজানো নয়। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা মানে তাদের ভালো পরীক্ষা দেওয়া এবং বাঁচার স্বাধীন অধিকার যাতে বিঘ্নিত না হয় সেটা নিশ্চিত করা।
স্বাধীনতা মানে সেই বাংলা বন্ধ বা সেই রেল রোকো নয় যাতে রাস্তায় থমকে যায় এম্বুলেন্স,অফিস যাওয়ার তাগিদ,অনেকদিন পর বাড়ি ফেরার আনন্দ।স্বাধীনতা মানে অন্যের চলাচলের ন্যায্য অধিকারকেও সুগম করে দেওয়া।
স্বাধীনতা মানে কিন্তু দাম্পত্যে পরস্পরের অন্যের সঙ্গে মেলামেশায় অযৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপ বা লক্ষ্মণরেখা কেটে দেওয়া নয়, পরস্পরের স্বাধীনতার অধিকার ও স্বাদকে বাঁচিয়ে রাখা।স্বাধীনতা মানে পশুত্ব জাহির করে নারী ধর্ষণ বা প্রতিশোধস্পৃহা থেকে কোনো নির্দোষ পুরুষকে মিথ্যে ধর্ষণের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া নয়, স্বাধীনতা পারস্পরিক শ্রদ্ধা,বিশ্বাস এবং প্রতিবাদের প্রতীকও। স্বাধীনতা মানে কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, কারো ধর্মাচার বা বিশ্বাসকে কালি মাখানো নয়, স্বাধীনতা মানে ধর্মের ধর্মের প্রতি সহনশীলতা এবং গোষ্ঠীর সঙ্গে গোষ্ঠীর বন্ধুতাও।
আমরা অনেক ক্ষেত্রেই এসব মানিনা।আমরা স্বাধীনতাকে উশৃংখলতা ভাবি।আজও।এখনো।
স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরেও আমাদের অধিকার অর্জনের জন্য প্রতিবাদী হতে হয়,আন্দোলন করতে হয়,চিৎকার ও অনশন করতে হয়।আমরা ভুলে যাই এ দেশ যতটা একজন পুরুষের,ততটা নারীরও।যতখানি একজন ভিখারির,ততখানি একজন অর্থবানেরও।একজন উচ্চশিক্ষিত,বা একজন নিরক্ষর,একজন আস্তিক,একজন নাস্তিক সবারই দেশের প্রতি স্বাধীনতার প্ৰতি সমান অধিকার।
এসব আমরা বুঝিনা তা নয়।কিন্তু তা সত্ত্বেও, স্বাধীনতার এতবছর পরেও,শুধু মাত্র ‘আমরাই সঠিক,আমরাই আল্টিমেট’ এই আত্মশ্লাঘা বার বার প্রমাণ করে ছাড়ে যে,আসলে আমরা স্বাধীনতার মানেই বুঝিনা। আমাদের মানবিকতার সর্বনাশ হয়ে চলে সর্বদা।
এটা মনে রাখতে হবে ,কোনো একজন যদি কোনোকিছুকে সত্যি বা মিথ্যে ভাবে, ঠিক বা ভুল ভাবে,যৌক্তিক বা অযৌক্তিক,প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে সেটাই কিন্তু ভাবনা হিসাবে আল্টিমেট নয়।তাতেও অনেক তর্কের অবকাশ থাকে।হার জিতের সম্ভাবনা থাকে।শুধু মাত্র নিজেদের বিশ্বাসে আস্থা দেখালে অন্যের বিশ্বাসে অনাস্থার অনধিকার চর্চাও করা হয় ।এ দেশ অনেক বড়।অনেক উদারতার গাথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে জেগে আছে,ঘুমিয়ে আছে এর আকাশ,বাতাস ও মাটিতে।সে দেশের গর্বিত নাগরিক হয়েও কেন আমরা এখনো মনের দিক থেকে শিক্ষিত এবং উদার হতে শিখি না? কে ঠিক কে ভূল এ বিচারের ভার কেন ভাবীকাল ও ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না?
পারিনা তার কারণ হলো আমরা এখনো শিখিনি যে স্বাধীনতা ও অধিকারবোধ ভাগাভাগি করে উপভোগের জিনিস।কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এ বস্তু বুঝতে গেলে আমাদের আরো অনুভবী হতে হবে অন্যের ভালো থাকার এবং স্বাধীনতার ব্যাপারেও। নিরবচ্ছিন্ন স্বাধীনতা ও শান্তিতে একসাথে বেঁচে থাকার জন্য কবির কথা আজ এতদিন পরেও প্রাসঙ্গিক ও স্মরণীয়। “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি”?
●●●●●●●●●●●●●
#পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫.০৮.২০২০