রবি ঠাকুরের দ্বিতীয় বার মৃত্যু আর আতেল বাঙালির সংস্কৃতির চোঁয়া ঢেকুর
ড: পলাশ বন্দোপাধ্যায় , কলকাতা , ৮ জুলাই ২০২০
“বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস যত কম হয় ততই ভালো । না হলে নিজের ভিড়ের ঠ্যালায় সে নিজেই মাঝারি হয়ে যেত ~ শেষের কবিতার অমিত রে যে আশঙ্কা করেছিলেন আজ তা ঘোর বাস্তব । রোদ্দুর রায়ের মতো বিশ্ব মহামানব ,না হলে ছাপোষা বাঙালী রবি ঠাকুরের গান নিয়ে প্যারোডি করতে সাহস পায় ।” ~ সুমন মুন্সী সম্পাদক , আইবিজি নিউজ
বাঙালির একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন বলে এখন বাঙালি খুব তৃপ্ত।নিশ্চিন্ত।গর্বিত হওয়া,অহংকার করা,আন্তর্জাতিক মহলে জাতি হিসেবে জাতে ওঠা ওসব পুরোনো চ্যাপ্টার।আগেই পড়া হয়ে গেছে।নিশ্চিন্ত হওয়াটা একটা নতুন চ্যাপ্টার। নবতম প্রাপ্তি।বিশ্বকবির নবতম খ্যাতির বিড়ম্বনা। অস্বস্তি এবং লজ্জারও।অমরত্বের বাসনাহীন এ মহাপুরুষকে তাঁর অজ্ঞাতে ও অনিচ্ছায় কতবার যে ছোট হতে হয়,মাটিতে নামতে হয় এ কারণে, তা আর না গোনাই ভালো।
অনেক গল্প,অনেক ঘটনা, সবকটাই বাস্তব।কোনটা বলবো আর কি শুনবেন?
একটা সময় ছিলো যখন ধনী সমাজ এবং শিক্ষিত সমাজ বাঙালির এই দুই ক্লাস ছিলো।এদের মধ্যে পায়ে পা দিয়ে কোনো ঝগড়া ছিলো না।ধনীরা শিক্ষিতদের শ্রদ্ধা করতেন।শিক্ষিতেরা ধনীদের ঘাঁটাতেন না।পারস্পরিক বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যা হয়নি।এই দুইয়ে মিলে আর একটা শ্রেণীও ছিলো তা হলো শিক্ষা এবং ধনের সফল মিশেল।সে শ্রেণীরও মূল আনাগোনা ছিলো শিক্ষিত সমাজেই।অর্থই জীবনের মূল এ তাঁরা মনে করতেন না।
একটা সময়ের পর থেকে পাশ্চাত্য অর্থনীতির প্রলোভন এবং আরো পরে বিশ্বায়ন,এসবের কারণে একটা গোলমাল শুরু হলো।এবং ধনীদের ক্ষেত্রে দুই ক্লাস মিলে একটা অক্ষম খিচুড়ি ক্লাস তৈরি হলো।শিক্ষিতদের অর্থবান হওয়ার মধ্যে জটিল গল্প কিছু নেই।মেধাকে ডিগনিটি না খুইয়েও বিক্রী করা যায়।কিন্তু ধনীর নিজেকে শিক্ষিত প্রমাণ করে জাতে ওঠার চেষ্টার খেলা শুরু হতেই লাগলো গন্ডগোল। অন্যদের সাথে সাথে সবথেকে বেশি বিপদে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলার গর্বের শেষ নেই,এ হলো এক চরমতম সত্যি।কিন্তু তাঁর কারণে বাঙালির জাতি হিসেবে একটা সমগ্রিক বিপদও হয়েছে,এবং তা হয়েছে তাঁর অজ্ঞাতে।বিশ্বকবি কোনো বিষয় ছেড়ে যাননি।পার্থিব সব ঘটনার সব অলিতে গলিতে অবাধে বিচরণ করে কবিতা,গল্প,উপন্যাস,প্রবন্ধ,নাটক,প্রহসন কোনো না কোনো আঙ্গিকে সব বিষয় নিয়ে আল্টিমেট কথাটা তিনি লিখে চলে গেছেন। এ সমুদ্র পরিমান সৃষ্টি একজন বিদ্বান মানুষের জীবদ্দশাতেও অনুভব করে পড়ে ফেলা কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব।
বিদ্বান যাঁরা নন তাঁরাও এ কথা বিলক্ষণ জানেন,বোঝেন।ফলত তাঁকে নিয়ে টানাটানি করতে কারো দ্বিধা বা রুচিতে বাঁধা কোনোটাই হয়নি।
বড় প্রমোটার তাঁর প্রজেক্টের সামনে,অর্থ হোক বা না হোক রবীন্দ্রনাথের কোটেশন দিয়ে কাটআউট দেন।প্রজেক্টের নাম করেন রবীন্দ্র সৃষ্টি বা রবীন্দ্র সৃষ্ট চরিত্রের নামে।সমাজবিরোধী অথবা সুদের কারবারিরা সন্ধ্যেবেলা গঙ্গা স্নান সেরে এসে রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে বসেন।কিছু ধান্দাবাজ ধূর্ত রাজনৈতিক নেতা রেফারেন্স বই থেকে রবীন্দ্র কোটেশন বের করে সুযোগমতো হাওয়া গরম করেন।মাছের বাজারে সাংস্কৃতিক পরিবেশ ফেরানোর জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজে।কোনো কোনো স্কুলের বইয়ে রামমোহনের নাম লিখে রবীন্দ্রনাথের ছবি ছেপে দেওয়া হয়।
সহজপাঠ বিদ্যাসাগরের লেখা বলে দুই মহাপুরুষকেই অপমান করা হয়।বোকা ছাত্র পরীক্ষার উত্তর লেখার সময় নিজের লেখাকে ইনভার্টেড কমার মধ্যে চালান করে রবীন্দ্র কোটেশন বলে চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে।শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের ব্যাখ্যায় গন্ডগোল হয়ে যায়….
অর্থাৎ, দাঁড়ালো এটাই,আগে যা ছিলো শিক্ষিত সমাজের গর্ব এবং সম্পদ, এখন সেসব কিছু ছাড়াও উন্নয়ন থেকে অবনয়ন সব জায়গাতেই তাঁকে নিয়ে দড়ি টানাটানি।ডানপন্থায় রবীন্দ্রনাথ,বামপন্থায় রবীন্দ্রনাথ,মধ্যপন্থায় রবীন্দ্রনাথ,শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ,অশিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ।রবীন্দ্রনাথই যেন সর্বরোগহরবটিকা।তিনিই যেন সব সমস্যায় রক্ষাকবচ।
তাঁর গোটা জীবনের নিরন্তর সাধনার কি করতে গিয়ে কি যেন হয়ে গেল।ঈশ্বরের মুক্তি নেই।
“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়” আজ অন্য অর্থে প্রাসঙ্গিক হয়ে আপামর বাঙালির দুঃখের বোঝাটা আরো একটু বাড়িয়ে দিয়ে গেল যেন।
●●●●●●●●●●●●●
#পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়
০৭.০৮.২০২০