এটা বাঙালির চায়ের দোকান – এখানে নোবেল জয়ীর গুরু ও ব্র্যাডম্যানের বাবা থাকেন
ড: পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়,কলকাতা,২৯ জুলাই ২০২০
পঞ্চানন খুড়ো প্রাক্তন বামপন্থী সমর্থক এবং ইদানীং ধুতি পরা হুঁকো খাওয়া বাষট্টি বছরের গ্রাম্য বুড়ো।জীবনে তাঁর অনেক কিছুই হতে পারতো।তিনি একটা ছোট মুদির দোকান দিতে পারতেন।তিনটে রিকশা কিনে তা ভাড়ায় দিতে পারতেন।আয়া ও নার্সেস সেন্টার খুলতে পারতেন।কিছুই করেননি, কারণ তার গুলতানি করা আর খেয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কিছু করতে ভালো লাগেনা।যে সরকারি চাকরিটা থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন সেই ডিপার্টমেন্টের অস্তিত্ব বলতে গেলে প্রায় তার জন্মলগ্ন থেকেই নেই, কিন্তু মাস গেলে নিয়মিত মাইনের ব্যবস্থাটা আছে।অফিস বিল্ডিংও এমন কি নেই।সুতরাং বহু আগে থেকেই তিনি ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ অথবা ‘স্লীপ এট হোম’।
তা এই পঞ্চানন খুড়োর মস্ত এক কাল্পনিক প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন।তিনি হলেন অমিতাভ বচ্চন।যাঁর কথা শুনলেই তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন।এমনিতে এমন হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ তিনিও খুঁজে পাননি কোনোদিন।অমিতাভ বচ্চনও এই নিয়ে কোনোরকম দুঃখে আছেন বলে শুনিনি।
গোদা বিশ্লেষণেই অবশ্য তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আটকে যাচ্ছেন।অমিতাভ বচ্চন ছ ফুট সাত ইঞ্চি।তিনি এখনো ফিট থাকলে চার ফুট দশের ফুটবল খেলতে পারতেন।অমিতাভ বচ্চনের গলা ভরাট।ওনার গলা মিহি।অমিতাভ বচ্চন একজন ওয়ার্ল্ড আইডল, উনি একজন স্থানীয় মুরগি।
সেদিন তার গ্রাম জিওলডাঙার দাসপাড়ায় ফোকলা আনসারের চায়ের দোকানে খেটো ধুতি পরে বসে এক হাতে চায়ের ভাঁড়,আর এক হাতে খবরের কাগজ নিয়ে মাঝে মাঝে থেলো হুঁকো টানতে টানতে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে ভাঙা বেঞ্চ গরম করছিলেন খুড়ো,-‘এই অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কি আছে? কাগজগুলোর কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? উনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভক্তদের উদ্দেশ্যে কি বললেন,কতখানি অরুচি হলো,কেন খেতে পারছেন না,অভিষেক এসব দেখে কতখানি আপসেট হয়ে পড়লো,উনি নিজে বাথরুমে যেতে পারছেন কিনা,এসব জেনে মানুষ কি করবে?
বক্তৃতা জমে উঠেছিলো। হাফ প্যান্ট পরা ফোকলা আনসার মাঝে মাঝে পঞ্চানন খুড়োকে আরো এক ভাঁড় চা এবং পিনিক দিয়ে যাচ্ছিলো।
বাঙালি সমাজের একটা গুন আছে।যে কোনো ধরণের যে কোনো প্রোফাইলের মানুষের,তিনি যদি একটু কথাবার্তায় চৌকস হন,সে যতই ভাট বকুন না কেন, দু একটা চামচা জুটে যায়।পঞ্চানন খুড়োরও
কয়েকজন তেমন আছে যার মধ্যে পাঁচকড়ি মাতাল আর পাগলা মদন প্রথম সারির।তারা সপ্রশংস দৃষ্টিতে হাঁ করে বসে খুড়োর কথা গিলছিলো আর মাঝে মাঝে কিছু না বুঝে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলো।
পাশের পাড়ায় এক মহা পাকা ছেলে থাকে তার আসল নাম কেউ জানেনা।সবাই ফিচলে পটলা বলে ডাকে।ঊনত্রিশ বছর বয়স।লগার মতো পাকানো শরীর।কাজ কাম নেই।বাবার হোটেলে খায় আর সাইকেল ঠুনঠুন করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়।ব্যাপার দেখে সে সাইকেল থেকে নেমে হাসি হাসি মুখে পঞ্চানন খুড়োর পাশটাতে এসে বসলো।বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁর বক্তব্যের গতিপ্রকৃতি আঁচ করে সে বলতে শুরু করলো-
‘সত্যিই তো খুড়ো! এটা একেবারেই ঠিক হয়নি।একটা জোর প্রতিবাদ আন্দোলন হওয়া দরকার।কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারে আমার একটু জানার ছিলো।আচ্ছা,ধরো মিডিয়া অমিতাভ বচ্চনের কথা না লিখে তোমার কথাই লিখতে গেল ভালো;তাহলে কি দাঁড়াবে সেটা?…আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পঞ্চানন খুড়ো এক ঘটি চা দিয়ে আধ ধামা মুড়ি খাওয়ার পর থেকেই হঠাৎ তাঁর তীব্র পেটের যন্ত্রণা শুরু হয়।তাতে অত গুরুত্ব না দিয়ে তিনি যখন দুপুর বেলা ফলি মাছের ঝাল আর এক থালা ভাত নিয়ে সবে মাত্র বসেছেন,তখন তাঁর হঠাৎ বমি শুরু হয় এবং এমনকি একবার কাপড়চোপড়েও খানিক হয়ে যায়।পাশে তাঁর সহধর্মিনী বেজাবালা বসেছিলেন।ব্যাপার দেখে তিনি প্রচন্ড রেগে গালাগাল করতে করতে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে সেখান থেকে উঠে যান….
নাহ! হচ্ছে না! খুড়ো, তুমি নিজেই বলো! ব্যাপারটা কি অমিতাভ বচ্চনের খবরের মতো অতখানি জমছে?
এর পর পটলা সাইকেলে উঠে স্পীডে
পালিয়েছিলো না পঞ্চানন খুড়োর রাগের চোটে চশমা খুলে গেছিলো তা বিবেচ্য নয়।বলার কথা হলো এই,যে,মধ্যবিত্ত গড়পড়তা বাঙালিদের অনেকেরই অনেক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কি যেন ঘটে যায় মাঝ পথে। কেবল মাত্র নিজেদের সীমাহীন আলস্যে,অনেক দূর থেকে দেখা আবছা হয়ে যাওয়া মিছিলের অবয়বহীন, নাক মুখ চোখহীন অস্তিত্ব হয়ে গোটা জীবন সুখে নির্বিকারে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য,রেডিও কাগজ ও টিভিতে আরো বেশি খবর হতে পারতো জাতটার তাই বিশেষ কিছু হয়না।
●●●●●●●●●●
#পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়
২৯.০৭.২০২০