রাজ্যে হিংসা ছড়ালে কাদের স্বার্থপূরণ হবে? এতে ক্ষতিইবা হবে কাদের? ভেবে দেখার অনুরোধ
মোশারফ হোসেন (সাংবাদিক ও সভাপতি জনতার একতা)
নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি’র বিরুদ্ধে শুক্রবার থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভের নামে যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে, প্রথমেই তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করছি। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন বলে পরিচিত একশ্রেণীর মানুষ রাস্তায় নেমে ট্রেনে-বাসে আগুন, রাস্তা অবরোধ, ইট-পাথর বৃষ্টি প্রভৃতি চালিয়ে তাঁরা নয়া আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা যে পথে করতে চাইছেন, তাতে আসলে তাঁরাই আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটা সম্ভবত তাঁরা ভেবে দেখছেন না। আজ উত্তেজনার বশে অথবা কারও প্ররোচনায় যা করছেন তাতে নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারছেন বললে কম বলা হবে।
নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং তার পিছন পিছন এনআরসি প্রক্রিয়া চালুর যে চেষ্টা চলছে, তা আদতে সত্যিই মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়। কেউ নাগরিকত্ব লাভ করলে আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে না। যাঁরা এদেশে বসবাস করছেন, তাঁরা যে কারণেই এদেশে এসে থাকুন না কেন- তাঁর এদেশকে ভালোবেসেই, আশ্রয়দাত্রী বলে বিবেচনা করেই এখানে বসবাস করছেন। সূতরাং তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে (মুসলিম) যেভাবে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে তা সমর্থনযোগ্য নয়। বরং এই আইন কার্যকরের পর এনআরসি চালু করে কার্যত একমাত্র মুসলিমদের উপরই নিজেদের প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় চাপিয়ে দেওয়া হবে। এবং নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যেসব নথিপত্র চাওয়া হতে পারে, যেগুলির অধিকাংশই হয়তো বহু সাধারণ মুসলিমের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হবে না। ফলে ওই প্রক্রিয়া কার্যকর হলে সমুহ বিপদের মুখে পড়তে হবে লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁর সরকার ক্ষমতায় থাকতে এরাজ্যে কোনওভাবেই নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি কার্যকর করা হবে না। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তারা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গেও ওই দুটি প্রক্রিয়া কার্যকর করেই ছাড়বেন।
আমার মনে হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতক্ষণ রাজ্যের সরকারি ক্ষমতায় থাকবেন, ততক্ষণ নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি এরাজ্যে কার্যকর হবে না। কিন্তু তিনি ক্ষমতা হারালেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও তাদের সঙ্গীসাথীরা পশ্চিমবঙ্গের ওপর রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপর তাদের লক্ষ্যপূরণে যা যা দরকার, তা করবে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর করে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করবে। তারপর এনআরসি চালুর উদ্যোগ নেবে। এজন্য প্রথমেই তাদের দরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উৎখাত করা।
গত দু’দিন ধরে প্রতিবাদের নামে একশ্রেণীর মুসলিম যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তাতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অভীষ্ট পূরণের পথ পরিষ্কার হবে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি দেখিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের ধুয়ো তোলা হবে। এবং ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে অচিরেই তা কার্যকর করা হতে পারে। তারপর রাষ্ট্রপতি শাসনের মধ্যেই নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং এনআরসি কার্যকর করা হতে পারে।
আর, যে কোনও সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ কোনও রকম হিংসাত্মক কাজকর্ম পছন্দ করেন না। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হোক, তা তাঁরা চান না। রেল অবরোধ করে, বাস-ট্রেনে আগুন লাগিয়ে, পুলিশের ওপর ইট পাথর ছুঁড়ে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে তুললে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের সহানুভূতি হারাতে হবে। রাজ্যের অল্প কিছু আবেগপ্রবণ অথবা অন্যের দ্বারা প্ররোচিত মুসলিম নাগরিক সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার মতো কাজ করলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের তো বটেই, নিজেদের সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল অংশেরও বিরাগের কারণ হয়ে দাঁড়াবেন। এটা নিজেদের গলা নিজেরা কাটার ব্যবস্থাই বলা যায়।
তাই, প্রতিবাদের নামে আইন হাতে তুলে নিয়ে শত্রুদের হাত শক্ত করবেন না। কেউ তা করতে চাইলে বাধা দিন। শত্রুপক্ষের স্বার্থেই আপনাদের প্ররোচিত করার চেষ্টা চলতে পারে। আপনাদের ঠেলে দেওয়া হতে পারে বিপথে। তাতে রাজ্যের ক্ষতি তো বটেই, তারও চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আপনাদেরই। তাই কোনওরকম হিংসাত্মক কাজকর্মে অংশ নেবেন না। কেউ প্ররোচনা দিতে চাইলে তাকে চিহ্নিত করে প্রশাসনের হাতে তুলে দিন। রাজ্য সরকারের হাত শক্ত করুন। নইলে অদূর ভবিষ্যতেই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হতে হবে রাজ্যের মুসলিমদেরই।
প্রতিবাদ যথার্থ। কিন্তু তা হোক শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে। কোনওরকম হিংসাত্মক কাজকর্ম সঠিক পথ হতে পারে না। সবাই ভালো থাকুন। শান্তিতে থাকুন। অন্যের শান্তিভঙ্গের কারণ হবেন না। তাহলে আসলে নিজের জন্যই অশান্তি ডেকে আনার পথ প্রস্তুত করা হবে। সেটা কোনওভাবেই কাম্য নয়। আমরা সবাই দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক। সেই দায়িত্ব পালন থেকে সরে যাবেন না।
আবার বলছি, রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। কেউ তা নষ্ট করতে চাইলে প্রতিহত করুন।